বাংলাদেশের সংবিধান বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কারন সংবিধান থেকেই প্রিলি, লিখিত এবং ভাইভাতে প্রশ্ন আসে। রাষ্ট্রের সংবিধান হল শাসনতন্ত্র বা সর্বোচ্চ আইন। বাংলাদেশের সংবিধান লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয়। তবুও সময়ের প্রয়োজনে ১৬ বার পরিবর্তিত হয়েছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজনে আরও হতে পারে। বিসিএস পরীক্ষার্থীদের জন্য সংবিধানের ইতিহাস ও পরিবর্তনের ইতিহাস ভালোভাবে জেনে নেওয়া দরকার। ক্যাডার হতে হলে আপনাকে অবশ্যই সংবিধানের উপর ভালো দখল রাখা জরুরী।
সম্প্রতি ৪১ তম বিসিএস প্রিলি শেষ হবার পর সামনেই আসছে লিখিত পরিক্ষা৷ লিখিত পরিক্ষায় সংবিধান অংশে ভালো করার নানা কৌশল নিয়ে বর্তমান সময়ের সাথে কথা বলেছেন ৩৬ তম বিসিএস পুলিশে (সুপারিশপ্রাপ্ত) সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ রুবেল হক৷ তার মুখোমুখি হয়েছিলেন ওয়াহিদ তাওসিফ মুছা।
বর্তমান সময়- সংবিধান অংশের শুরুটা কিভাবে করতে হবে?
মোঃ রুবেল হক– প্রথমেই মহান মুক্তিযুদ্ধের উপর ভালো ধারণা থাকলে সংবিধান পড়তে ভাল লাগবে। ১৯৭২ সালের সংবিধান হল মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন। যদিও সংবিধানের ভাষা খুব উচু মানের । উপনিবেশিক কারনে হয়ত সংবিধানের ভাষা এই রকম। যারা বিচারকার্য পরিচালনা করত তারা ছিল ইংরেজ, তারা চাইত না এদেশের সাধারণ মানুষ আইনের ভাষা বুঝতে পারুক । তারা যে আইন চালু করে গেছে, আজও আমাদের দেশের আইন বিশেষজ্ঞরা তেমন পরিবর্তন করতে পারেনি। আইনের ভাষা এক্ষনও এলিট শ্রেণিদের মানুষের জন্যে । বিভিন্ন ধরনের আইন পড়তে গেলে বাংলার চাইতে ইংরেজি ভার্সন টাই ভাল বুঝতে পারা যায় । রসায়ন,পদার্থের ভাষা বুঝতে এতো কষ্ট হয়নি যতটা হয়েছে সংবিধানের ভাষা বুঝতে। পড়তে পড়তে এক সময় সংবিধান সহজ মনে হবে। সংবিধান বুঝতে পারলে রাষ্ট্রের অন্যান্য পার্ট গুলো বুঝতে সুবিধা হবে। সিভিল সার্ভিসে আসবেন, সারাজীবন আপনাকে সংবিধান পড়তে হবে।
সংবিধান নিজের মত বুঝে বুঝে পড়াই শ্রেয়, উদাহরণ দিলে বুঝবেন- সংবিধানের ৯নং অনুচ্ছেদ হল জাতীয়তাবাদ, সংবিধানে যা লিখা আছে পড়ে মনে হল চর্যাপদ পড়ছি, কি রবীঠাকুরের কোন দুর্বোধ্য কবিতা পড়ছি, কিছুই বুঝি না । কিন্তু নিজের মত করে যখন বুঝলাম, তখন মনে হল এর চাইতে সহজ আর কিছুই নেই। কেউ শেরে-ই-বিসিএস হলে হুবহু মনে রাখতেই পারেন, সেটা আপনার মেধার পরিচয় ।
বর্তমান সময়- জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে বলুন।
মোঃ রুবেল হক- সংবিধানের ভাষা কঠিন তাই নিজের মত করে মনে রাখি, জাতীয়তাবাদ মানে হল একটি জাতীয় মনস্তাত্ত্বিক চেতনা যেটা বলে আমাদের দেশ বাংলাদেশ, পৃথিবীর সেরা দেশ, এই দেশের জন্যে আমি জীবন দিতে প্রস্তুত । সংবিধান হল বাংলাদেশের সর্বচ্চো আইন। তাহলে আইন কী? কিছুই না, Law is nothing but strong common sense. মানুষের জন্য আইন, কল্যানের জন্য আইন। আইন সার্বজনীন । পৃথিবীর সবকিছুই কোন না কোন আইন বা নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হয়। যেন মানবজাতি সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে। অধিকার বঞ্চিত মানুষ যেন অধিকার ফিরে পাই তার জন্যেই আইন।
সংবিধানের ভাগ ও অনুচ্ছেদ গুলোর একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে। তবে সংবিধানে ধারা বলে কোন কথা নেই । সংবিধান বিশেষজ্ঞ না হয়ে কেবল বুঝেন, অনুধাবন করেন, কিভাবে লিখলে ভালো নাম্বার পাবেন, সেটাই বার বার প্ল্যান করেন।
বর্তমান সময়- সংবিধানের ভাগ গুলো সম্পর্কে জানতে চাই?
মোঃ রুবেল হক- প্রথম ভাগ(১-৭খ): প্রজাতন্ত্র, অর্থাৎ যে তন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। প্রজাতন্ত্র হল জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত সরকার।
দ্বিতীয় ভাগ (৮-২৫) : রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি। এগুলো তাত্ত্বিক কথা। মূলনীতি চারটি নিজের মত বুঝার চেষ্টা করেন। চিন্তা করেন আমাদের ৭১ এর চেতনা কি ছিল । সংবিধানের মূলনীতি ও একাত্তরের চেতনার সাথে গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।
তৃতীয় ভাগ(২৬-৪৭গ) : মৌলিক অধিকার। থিউরি বা তাত্ত্বিক কথা কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ । এখান থেকে লিখিত পরীক্ষায় প্রশ্ন আসবেই ।
এই হল প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার। এবার শাসন,আইন ও বিচার বিভাগ।
চতুর্থ ভাগ(৪৮-৬৪), : শাসন/নির্বাহী বিভাগ-এদেরকে আপনি সরাসরি দেখতে পাবেন, এরাই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। প্রেসিডেন্ট,প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, সচিব, সশস্ত্রবাহিনী, আধাসামরিক বাহিনী সবাই এই ভাগের অন্তর্ভুক্ত। এরাই দেশ চালায়, মনে রাখা খুব ইজি । প্রেসিডেন্টের কার্যাবলী ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যাবলী এখানেই আছে।
পঞ্চম ভাগ( ৬৫-৯৩): আইনসভা,আইনবিভাগ বা পার্লামেন্ট যায় বলি না কেন। জাতীয়সংসদের কার্যাবলী হল আইন বিভাগ। ৩৫০ জন এমপি এই ভাগের অন্তর্ভুক্ত।পার্লামেন্টের মাঝেই আইন বিভাগের কাজ সীমাবদ্ধ। প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্ট আওবান করে ও মুলতবি ঘোষণা করে।এখানে এমপি দের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আইন বিভাগের কাজ হল দেশের কল্যানের কথা বিবেচনা করে সময়োপযোগী আইন তৈরি করা। আগে পার্লামেন্টে আইন তৈরি হয় তারপর সেটা যাচাই-বাছাই ও প্রয়োগের জন্যে আদালতে প্রেরণ করা হয়। এখানে এমপিদের কাজ, আপনি এদেরকে দেখতে পাচ্ছেন।
ষষ্ট ভাগ (৯৪-১১৭): বিচার বিভাগ –প্রধানবিচারপতি, আপিল বিভাগের বিচারক,হাইকোট বিভাগের বিচারক, অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ে গঠিত। বিচার বিভাগ আইনের যথার্থতা নিরূপণ করে ও আইন প্রয়োগ করে বিচারকাজ পরিচালনা করে ।
এবার আইন ও বিচার বিভাগের মাঝে পার্থক্য নিশ্চয় বুঝেছেন। অর্থাৎ সরকারের তিনটা গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হল শাসন,আইন ও বিচার বিভাগ। এবার আসেন তিনটা সাহায্যকারী ভাগ যারা দেশ পরিচালনায় সরকার কে হেল্প করে।
সপ্তম ভাগ(১১৮-১২৬) নির্বাচন কমিশন : সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করে উপযুক্ত প্রতিনিধি বাছাই করা হল নির্বাচন কমিশনের কাজ। এটা একটা ভিজিবল অর্গান। ৩৮তম বিসিএস এর জন্য প্রশ্ন আসার সম্ভাবনা বেশি।
অষ্টম ভাগ (১২৭-১৩২)মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকঃ CAG সরকারের আয় ও ব্যয় হিসাব দেখে। এরা হল ব্যাংকের দ্বিতীয় কর্মকর্তার মত। কাকরাইলের CAG office একবার দেখলে আর ভুলবেন না । অফিস টা খুব সুন্দর। অডিট ক্যাডারের কী যে পাওয়ার যারা সরকারি জব করেন তারাই জানে ব্যাংক ব্যতীত । ফরেন, পুলিশ, এডমিন ও জুডিশিয়ারি সবাই জানে এজি অফিস কী। পেনশন আর টেনশন দুই টাই পাওয়া যায় নাকি এখানে। ক্যাডারের ক্যাডার এডমিন জানতাম এখন মনে হয় জানা টা ভুল ছিল ।
নবম ভাগ (১৩৩-১৪১গ) বাংলাদেশ কর্মবিভাগ(PSC) : কর্মবিভাগের কাজ হল প্রজাতন্ত্রের উপযুক্ত কর্মকর্তা বাছাই করা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ করে। এই বিভাগের গঠন ও কার্যাবলী জেনে থাকা দরকার।
১০ম ভাগ(১৪২) সংবিধান সংশোধন ও ১১ম ভাগ(১৪৩-১৫৩) বিবিধ/ইত্যাদি এই ত সংবিধান।
বর্তমান সময়- ২ ও ২ক এর মাঝে পার্থক্য কি?
মোঃ রুবেল হোক- ২ অনুচ্ছেদ ১৯৭২ এর সংবিধান এবং ২ক সংশোধনের মাধ্যমে এসেছে।
বর্তমান সময়- এছাড়া আরও কি কি বিষয় জানা জরুরী ?
মোঃ রুবেল হোক- চতুর্থ ভাগ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা ও স্থানীয় শাসন । পঞ্চম ভাগের ৬৬, ৬৭, ৭০, ৭৫, ৭৬, ৭৭, ৮০, ৮১, ৮৪ ও ৯৩ নং গুরুত্বপূর্ণ।
ষষ্ঠ ভাগের ১০১,১০২,১০৬, ১০৮,১১৪ ১১৬ক ও ১১৭ নং গুরুত্বপূর্ণ। নবম ক ভাগের জরুরীবিধানাবলী অর্থাৎ ১৪১ক,১৪১খ,১৪১গ ।
পরিশেষে ১৪৫,১৪৫ক,১৪৮ ও ১৫৩ অনুচ্ছেদ ।
বর্তমান সময়- শিক্ষার্থীদের জন্য কি পরামর্শ থাকবে ?
মোঃ রুবেল হক- কেউ সংবিধান মুখস্থ করে না বা মুখস্থ করে রাখে না, কেবল বার বার বুঝে বুঝে পড়েন। একটা রাষ্ট্র অনেক কিছু নিয়ে গঠিত, আর সংবিধান রাষ্ট্রের সর্বচ্চো আইন , মাত্র ১৫৩ অনুচ্ছেদ। ভারতের সংবিধান ত অনেক বড়, Indian civil Service এ যারা অংশ গ্রহণ করে, তারা কিভাবে পারে, আশা রাখি আপনিও পারবেন। ভালোভাবেই পারবেন। আপনার আত্মবিশ্বাস আপনাকে অনেক এগিয়ে নিয়ে যাবে অসম্ভবকে সম্ভব করার পথে।
বর্তমান সময়- আমাদের সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ।
মোঃ রুবেল হোক- আপনাকেও ধন্যবাদ। বর্তমান সময়ের জন্য শুভকামনা ।