পর্যটন ডেস্ক,
বাংলাদেশের রূপ-সৌন্দর্য নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। বাংলার প্রতিটি পরতে পরতে মিশে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। যার একটি বড় অংশ দখল করে রেখেছে ৩৬০ আউলিয়ার দেশ, দেশের একমাত্র গ্রিন সিটি সিলেট। কী নেই এখানে? পাহাড়-পর্বত, নদী-লেক, হাওর, শহর-গ্রাম, সবুজ-নীল সব মিলিয়ে বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের রাজধানী। কয়েক বছর ধরে পর্যটকদের জন্য আদর্শ স্থান হয়ে উঠেছে সিলেট। প্রতিনিয়ত উদ্ভাবন হচ্ছে নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র। সেখানে ছুটে যান দেশের ভ্রমণপিপাসুরা। বিদেশ থেকেও আসেন অনেকেই।
সিলেটের অন্যতম দর্শনীয় স্থান টাঙ্গুয়ার হাওর। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছোট-বড় অনেকগুলো হাওর আছে। তার মধ্যে বিখ্যাত হয়ে উঠেছে সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির হাওর। বৃহত্তম হাওর হাকালুকির অবস্থানও সিলেটে। টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি একেক ঋতুতে একেক রূপ ধারণ করে। এখানে ভ্রমণের জন্য বর্ষাকাল যদিও আদর্শ সময়। তবে অনেকেই অতিথি পাখি দেখার জন্য শীতকালেও ঘুরতে যান।
অনেক দিন থেকে ইচ্ছা ছিল টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের। কর্মব্যস্ততার কারণে যাওয়া যাচ্ছিল না। একরাতে হঠাৎ সিদ্ধান্ত হলো টাঙ্গুয়ার হাওর যাবো। মূল পরিকল্পনা সাজালেন সাদেক ভাই, যিনি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সিনিয়র রিপোর্টার। সিদ্ধান্ত হলো বৃহস্পতিবার রাতে রওনা হবো। সাধারণত বেশিরভাগ মানুষ সিলেট হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর যান। তবে আমাদের প্ল্যান ছিল টাঙ্গুয়ার হাওর এবং নেত্রকোনার বিরিশিরি একসাথে ঘুরবো। আমরা ছুটলাম নেত্রকোনা হয়ে। বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১০টায় হাওর এক্সপ্রেসে রওনা দিলাম ৮ জন। গন্তব্য নেত্রকোনা।
ট্রেন ছুটে চলল ব্যস্ততার এ শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে, মুক্ত বাতাসের খোঁজে। বেশিরভাগ যাত্রী হাওর অঞ্চলের। তাই তাদের আচরণে সরলতা স্পষ্ট। আরেকটি দলের সাথে সাক্ষাৎ হলো, তারাও যাচ্ছেন ঘুরতে। ট্রেন ছুটছে আর রাত গভীর হচ্ছে। শহরের নিয়ন বাতির আলো দূরে ঠেলে ট্রেন ঢুকে যাচ্ছে অন্ধকারে। তখন পূর্ণিমা তিথির আগমনীর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে পৃথিবী। তাই গভীর রাতেও অন্ধকার ভেদ করে অনেক দূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়।
তখন অক্টোবর মাস, বর্ষার ঘন বৃষ্টির ছিটেফোটাও নেই। পৃথিবী তখন শীতের আগমনের জন্য প্রহর গুনছে। গভীর রাতে একটু দূরেও দেখা যাচ্ছে কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে। রেললাইনের পাশেই ধানক্ষেত, কেউবা করেছেন মাছের খামার, দূর গ্রামের উঠোনে জ্বলতে থাকা বাতির আলোও দেখা যাচ্ছে। শীতল বাতাসে কাঁপুনি না ধরলেও গায়ে শিহরণ জাগাচ্ছে। আরেক দিকে ছুটে যাচ্ছে ট্রেন। একে অনেকগুলো স্টেশন পেরিয়ে গেলাম, মনে আছে শুধু ময়মনসিংহ জংশনের কথা।
এখানে ট্রেন দীর্ঘসময় ধরে বিরতি নিলো। জংশনের লাল টিনগুলো দেখে ছবি তোলার লোভ সামলানো কষ্ট হয়ে গেল। সাথে যারা ছিলেন তাদের নিষেধ সত্ত্বেও নেমে পড়লাম স্টেশনে। অনেকগুলো ছবি নিলাম। তবে মাত্র একটি ভালো ছবি পেলাম। আবার ছুটতে থাকলো ট্রেন। ট্রেনে একটি খারাপ দিক হচ্ছে, তৃতীয় লিঙ্গের লোকদের জোর করে টাকা আদায় করার দৃশ্য। অনেকে তো টাকা আদায় করার জন্য নানারকম অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে ট্রেন ভ্রমণ করতে গিয়ে তাই অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়।
রাত আনুমানিক সাড়ে ৪টায় মোহনগঞ্জ জংশনে পৌঁছলাম। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, জংশনে মানুষের ছুটোছুটি। ট্রেন থেকে নেমে দেখলাম কয়েকটি গ্রুপ এসেছে। একে তো গভীর রাত, তার ওপর আবার অপরিচিত জায়গা। তাই তখনই রাস্তায় নেমে পড়ার সাহস করলাম না। অপেক্ষা চলতে থাকলো সূর্যোদয়ের। স্টেশনজুড়ে আমরা কয়েকজন। অনেকের আগে থেকে গাড়ি রেডি ছিল, তাই তারা চলে গেছেন। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে যখন সূর্য পুব আকাশে উঁকি দিলো, আমরা ছুটে চললাম টাঙ্গুয়ার হাওরের উদ্দেশে। একটি অটো ভাড়া করে ছুটতে থাকলাম ধর্মপাশার উদ্দেশে। মাঝপথে আমাদের সাথে যোগ দিলেন একটি জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় প্রতিনিধি।
ধর্মপাশা গিয়ে একদিন এবং একরাতের জন্য একটি ট্রলার ভাড়া করলাম। হাওরে যাওয়ার আগেই সকালের নাস্তাটা সেরে নিলাম সেখানে। ছুটতে থাকলো ট্রলার, একটু সামনে গিয়েই দেখতে পেলাম নির্মিতব্য সাড়ে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ ‘হাওর উড়াল সড়ক’। যা হাওর অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে দেওয়ার জন্য সরকারের আরেকটি মেগা প্রজেক্ট। মাথার উপরে উত্তপ্ত সূর্য, সাথে হাওরের সুবিমল বাতাস। এক অন্যরকম অনুভূতি। একদিকে ছুটছে ট্রলার, অন্যদিকে আশেপাশের ছবি তোলা। সবাই সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন, তাই কমবেশি ক্যামেরা চালানোয় দক্ষ। এমন বিস্তীর্ণ জলাভূমি আর সুবিশাল আকাশ পেয়ে চলছিল ফটোগ্রাফি। আনুমানিক ঘণ্টাখানেক চলার পর পৌঁছলাম ওয়াচ টাওয়ারের কাছে। টাওয়ারের তিন দিকজুড়ে অসংখ্য হিজল, করচ গাছ। যা পানিতে অর্ধডুবন্ত ছিল। হাওরের এ অংশের পানি সব সময় পরিষ্কার থাকে। সেখানে আগে থেকেই জটলা বেঁধে আছে মানুষের। ছুটির দিন হওয়ায় হয়তোবা একটু বেশিই ভিড়।
নৌকা থামামাত্রই কয়েকটি ছোট ছোট নৌকা ছুটে এলো। তাদের চালকও সবাই ছোট ছোট। তারা ৫০-১০০ টাকার বিনিময়ে ওয়াচ টাওয়ারের আশেপাশের জায়গা ঘুরিয়ে দেখায়। নৌকায় চড়ার পর তারা আঞ্চলিক ভাষায় নানারকম গান শোনায়। আগতদের বেশ মুগ্ধ করে এ গান। সিলেটি হওয়ার কারণে তাদের ভাষা বুঝতে তেমন অসুবিধে হয়নি। ঘণ্টাদুয়েক ঝাঁপাঝাঁপি আর সাঁতার কাটার পর ছুটলাম টেকেরঘাটের দিকে। সেখানে মূলত পরিত্যক্ত কয়লার খনি, তার পাশেই শহীদ সিরাজ লেক বা নীলাদ্রি লেক। টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের সুবিধা হচ্ছে, চাইলে একসাথে নীলাদ্রি লেক, শিমুল বাগান, বারিক্কা টিলা, লাকমাছড়া এবং জাদুকাটা নদী ঘুরে আসা যায়। কেউ নেত্রকোনা হয়ে ঢাকা ফিরতে চাইলে বিরিশিরির চীনা মাটির পাহাড় এবং উপজাতীয় কালচারাল সেন্টার ঘুরে আসতে পারেন।
টেকেরঘাটের দিকে ছুটছে ট্রলার। চোখের সামনে বিস্তীর্ণ হাওর। একদম শেষপ্রান্তে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বিশাল পাহাড়। দেখে মাঝেমাঝে আফসোস হচ্ছিল, ইস! যদি এগুলো বাংলাদেশ সীমান্তে হতো।
বর্ষায় হাওরের পানি ঘোলা থাকে। তবে বর্ষার শেষের দিকে পানি থাকে একদম স্বচ্ছ। তাই যখন গিয়েছিলাম; তখন পানি ছিল স্বচ্ছ। আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে হয়ে উঠেছিল একদম নীল। হাওরের মাঝখানে দ্বীপের মতো ছোট ছোট বাড়ি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বচ্ছ পানির সাথে নৌকা দোল খেতে খেতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম টেকেরঘাটে। একটু সামনেই মেঘালয়ের উঁচু উঁচু পাহাড়, মনে হয় যেন হাত বাড়ালেই ধরা যাবে। কিন্তু ওগুলোতে যাওয়া যাবে না। কারণ সীমান্তের কাঁটাতার বিভক্ত করে দিয়েছে দুই দেশের মানুষের প্রবেশাধিকার।
টেকেরঘাট যখন নামলাম; তখন বিকেল হয়ে গেছে। এখনো দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি। তাই সবাই ছুটলাম ঘাটের পাশেই একটা স্থানীয় বাজারে। সেখানে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে চললো হাঁসের মাংস দিয়ে ভুড়িভোজ। দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই ছড়িয়ে পড়লো যে যার মতো। আমি আর সাদেক ভাই গেলাম বাজারের পাশে বেদে পল্লিতে, সেখানকার মানুষের জীবন সম্পর্কে জানতে, তাদের সাথে মিশতে। ক্যামেরা আর বোম দেখে পল্লির শিশুরা ছবি তোলার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠলো। বসতির সর্দার আর সাধারণ বেদেদের যখন সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম, তখন ছেলেরা ক্যামেরায় নিজেকে দেখানোর জন্য বারবার ক্যামেরার সামনে আসতে লাগলো, তবুও তাদের বাধা দিলাম না। অল্প সময়ে তাদের সাথে কথা বলে তাদের জীবনের অনেক অজানা গল্প জানা হয়ে গেল। মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিভাবে একটা জাতি তাদের পুরো জীবন কাটিয়ে দিতে পারে নৌকার মধ্যে। এখানেই তার বসত, এখানেই কাটে জীবন। বেদে সম্প্রদায়ের লোকজনের সাক্ষাৎকার নিতে নিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সন্ধ্যার সময়টা কাটালাম নীলাদ্রি লেকের পাশেই। সন্ধ্যার সাথে সাথেই সীমান্তে জ্বলে উঠলো হলুদ বাতি। বাতির আলো যখন নীলাদ্রির পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছিল, তখন অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছিল।
যখন পুরোপুরি রাত হয়ে গেল; তখন একদল চলে গেল বাজার করতে। সিদ্ধান্ত হলো রাতে ট্রলারেই রান্না হবে। সাধারণত যারা টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরতে যান; তারা সবাই টেকেরঘাটে হাওরের পাড় থেকে একটু দূরে নোঙ্গর করে রাত কাটান। তবে আমাদের অনেকে চাইলেন ওয়াচ টাওয়ারের নিচে রাত কাটাবেন। তাই বাজার করা শেষে নৌকা ঘুরিয়ে দেওয়া হলো ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। পূর্ণিমা রাত, স্বচ্ছ পানিতে চাঁদের আলো চিকচিক করছিল। নৌকা যখন হাওরের মাঝখানে নোঙ্গর করল, তখন বাতাসের গতিবেগ বেড়ে গেছে। বাতাসের সাথে দুলছিল ট্রলার। কেউ কেউ শুয়ে জোসনা বিলাস করছেন, কেউবা রান্নার কাজে ব্যস্ত। হাওরের মাঝখানে, সবাই নেটওয়ার্কের বাইরে, তাই ইচ্ছা করলেও ইন্টারনেটে কেউ লগইন করতে পারছেন না। এমন সময় হঠাৎ রশি বেয়ে ট্রলারে উঠে পড়ল একটি ঢোড়া সাপ। হয়তো ডাঙ্গায় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য উঠে এসেছিল ট্রলারে। মাঝি সাপটি মেরে ফেলতে চাইলেও বাধা দিলাম। তাই আবার হাওরে ফেলা দেওয়া হলো।
রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে শরীরে একটা অন্যরকম অনুভূতি হলো। হাওরের সবচেয়ে নিষ্প্রাণ ঢেউয়ের শব্দটিও কানে আসছে। কথিত আছে, হাওরের মাঝে ঘুরতে আসার পর অনেক পর্যটক ডাকাতির শিকার হয়েছেন। তাই এখন আর কেউ হাওরের মাঝখানে থাকেন না। সবাই টেকেরঘাটে রাত কাটান। এখন হাওরের মাঝখানে কেবল একটি ট্রলার, আর যাত্রী হাতেগোনা আমরা ক’জন। কমবেশি সবার মধ্যে ভয় ঝেঁকে বসেছে, টেকেরঘাট ফিরে যাওয়ার মতও পরিস্থিতি নেই। রাতের খাবার খেয়ে ভয় আর শঙ্কা নিয়ে সবাই ঘুমোতে গেলাম। কয়েকজন ছাদে, বাকিরা ট্রলারের ভেতরে। মনে মনে প্রহর গুনছিলাম, এই বুঝি এলো দস্যুর দল। লুটেপুটে নিয়ে গেল আমাদের সম্বল। সারারাত এভাবেই কাটল, কোনরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই রাত পেরিয়ে ভোর হলো, সকালে সূর্য উঠলো।
সকালে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আবার ছুটে চলল ট্রলার ধর্মপাশার দিকে। সেখান থেকে নেত্রকোনার বিরিশিরি আর উপজাতীয় কালচারাল সেন্টার ঘুরতে যেতে হবে। ফেরার সময় দেখলাম টাঙ্গুয়ার হাওরের এক ভিন্ন রূপ। ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে মাছ ধরছে জেলেরা। হাঁসের পাল দলবেঁধে করছে খাবারের আহরণ। এসব দেখতে দেখতে ট্রলার ছুটছে গন্তব্যে আর আমি ভাবছি বড্ড বৈচিত্রময় হাওরের মানুষের জীবন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।
বিএসডি/আইপি