ধর্ম ডেস্ক,
পবিত্র নগরী মক্কা ছিল মহানবী (সা.)-এর জন্মভূমি। মক্কাতেই তিনি তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলো কাটিয়েছেন। এমনকি নবী জীবনের ২৩ বছরের ১৩ বছরই মক্কাবাসীকে ইসলামের পথে আহ্বান করে কাটিয়েছেন। তবু মক্কাবাসীর ছিল অনেকটা নুহ (আ.)-এর জাতির মতো। যাদের ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, ‘সে বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক, আমি তো আমার সম্প্রদায়কে দিন-রাত আহ্বান করেছি। কিন্তু আমার আহ্বান তাদের পলায়ন-প্রবণতাই বৃদ্ধি করেছে। আমি যখনই তাদের আহ্বান করি—যাতে আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তারা কানে আঙুল দেয়, বস্ত্রাবৃত করে নিজেদের ও জিদ করতে থাকে এবং অতিশয় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে।’ (সুরা নুহ, আয়াত : ৫-৭)
এবং তারা তা করেছিল জেনে-বুঝে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা অন্যায় ও উদ্ধতভাবে নিদর্শনগুলো প্রত্যাখ্যান করল, যদিও তাদের অন্তর এগুলো সত্য বলে গ্রহণ করেছি। দেখো, বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কী হয়েছিল।’ (সুরা নামল, আয়াত : ১৪)
ইসলাম প্রত্যাখ্যান করার কারণ
আরব বিশ্বের খ্যাতিমান ইতিহাস গবেষক আলী মুহাম্মদ সাল্লাবি মক্কাবাসীর ইসলামবিমুখতার প্রধান সাতটি কারণ নির্ণয় করেছেন। তাহলো—
১. সীমাহীন অহংকার : মানুষকে ঈমান আনতে যেসব জিনিস বাধা দেয় তার অন্যতম অহংকার। বহু মানুষ এই মন্দ স্বভাবের কারণে ঈমান থেকে বঞ্চিত হয়েছে এবং তার সূচনা হয়েছে মানবসৃষ্টির প্রথম দিন থেকে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি যখন ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সেজদা করো। তারা সেজদা করল; কিন্তু ইবলিস করল না। সে অস্বীকার করল ও অহংকার করল। সে ছিল কাফিরদের অন্তর্গত।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ৩৪)
মক্কাবাসীর অহমিকার বর্ণনা পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে, ‘এবং তারা বলে, এই কোরআন কেন নাজিল করা হলো না দুই জনপদের কোনো প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির ওপর।’ (সুরা জুখরুফ, আয়াত : ৩১)
প্রতাপশালী দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য ছিল মক্কার ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা এবং তায়েফের উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফি। কেননা তাদের দৃষ্টিতে বিপুল বিত্ত-ভৈববের অধিকারী এই দুই ব্যক্তিই ছিল সবচেয়ে অভিজাত।
২. নেতৃত্ব হারানোর ভয় : মক্কাবাসীর ইসলাম গ্রহণে আরেকটি অন্তরায় ছিল নেতৃত্ব ও গোত্রীয় প্রভাব হারানোর ভয়। কেননা রাসুলুল্লাহ (সা.) পৃথিবীতে এসেছিলেন মানবজীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নের জন্য। তিনি এসেছিলেন মিথ্যা উপাস্যের বেড়ি থেকে মানুষকে মুক্ত করতে। আর মক্কার সর্দাররা এসব উপাস্য প্রতীমাদের সামনে রেখে মানুষের ওপর রাজত্ব করত। সুতরাং মক্কায় ইসলাম প্রসার লাভ করার অনিবার্য পরিণতি ছিল তাদের নেতৃত্বের পতন।
৩. আর্থিক স্বার্থ হারানোর ভয় : মক্কার তৎকালীন পরিবেশ ও অবস্থার ওপর নির্ভর করত কিছু মানুষের আর্থিক স্বার্থ। কেননা মক্কা ছিল প্রাচীনকাল থেকে আরবের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র। পবিত্র কাবা ঘর ছাড়াও এখানে ছিল প্রধান প্রধান আরব দেবীর প্রতীমা। ফলে মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হলে এবং সেখান থেকে মূর্তি সরিয়ে ফেললে তীর্থ যাত্রীদের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাবে। তা ছাড়া এই সম্ভাবনাও ছিল যে মক্কাবাসী ইসলাম গ্রহণ করলে আরবের অন্যান্য অঞ্চলের লোকেরা সেখানে হামলা করে বসবে।
৪. ভোগ-বিলাস বন্ধ হওয়ার ভয় : মক্কাবাসী মদ, জুয়া, বেশ্যাবৃত্তিসহ নানা ধরনের অন্যায় ও অনৈতিক ভোগ-বিলাসে ডুবে ছিল। এসব অনৈতিকতার বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট ও কঠোর, যা তাদের ইসলামগ্রহণের পথে অন্তরায় ছিল।
৫. সুস্থ বিবেকের অভাব : মক্কাবাসী বিবেক, বুদ্ধি ও যুক্তির পথ পরিহার করে অন্ধত্বের পথ গ্রহণ করেছিল। মক্কাবাসী ছিল বহু প্রতীমা ও উপাস্যের পূজারী, যা যেকোনো সুষ্ঠু বিবেকের অধিকারীর কাছেই অযৌক্তিক মনে হবে। বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দেওয়া মক্কাবাসীকে এক আল্লাহর ইবাদত করার আহ্বান করা হলো, তখন তারা বলল—‘সে কি বহু উপাস্যকে এক উপাস্যে পরিণত করছে? নিশ্চয়ই এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার।’ (সুরা সাদ, আয়াত : ৫)
৬. সামাজিক কুসংস্কার : সামাজিক রীতি ও সংস্কারের কারণে মক্কার বহু মানুষ আল্লাহর পরিচয় লাভ করার পরও ইসলাম গ্রহণ করেনি। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি বলুন, সাত আসমান ও মহান আরশের প্রতিপালক কে? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। বলুন, তোমরা কি ভয় করবে না।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৮৬-৮৭)
৭. প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস : প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস মক্কাবাসীর অন্তরে বদ্ধমূল হয়েছিল, যা বহু বিষয়ে ছিল ইসলামের বিপরীত। ফলে তারা ইসলাম গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলো। যেমন—প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস অনুসারে কোনো মানুষ আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। সুতরাং যখন কোনো মানুষকে নবী করে পাঠানো হলো, তারা বিস্মিত হলো। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘সত্য আসার পর মানুষকে ঈমান গ্রহণে বাধা দিয়েছে শুধু তাদের এই কথা—আল্লাহ কি একজন মানুষকে রাসুল করে পাঠিয়েছেন?’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৯৪)
মোটকথা, মক্কাবাসী ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত নানামুখী স্বার্থ, সামাজিক রীতি, সংস্কার ও অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের কারণে নতুন জীবনব্যবস্থা ইসলাম গ্রহণে মোটেই প্রস্তুত ছিল না। অবশ্য সব নবী-রাসুলের ব্যাপারে প্রায় একই আচরণ করেছে স্বগোত্রীয়রা। আল্লাহ বলেন, ‘এভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোনো রাসুল এসেছে, তারা তাকে বলেছে, তুমি এক জাদুকর, না হয় এক উন্মাদ।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ৫২)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তারা আপনাকে অস্বীকার করে, তোমার আগে যেসব রাসুল স্পষ্ট নিদর্শন, আসমানি সহিফা এবং দীপ্তিমান কিতাবসহ এসেছিল, তাদেরও তো অস্বীকার করা হয়েছিল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৮৪)
বিএসডি/এএ