ডা. মুহাম্মাদ সাঈদ এনাম ওয়ালিদ
প্রায়শই বলতে শোনা যায় দিন দিন নতুন নতুন রোগ দেখা যাচ্ছে। আসলে বিষয়টি ঠিক ওরকম নয়। রোগ গুলো আগে ছিলো, কিন্তু জানা ছিলো না রোগ নিরুপন পদ্ধতি। দিন দিন চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে আমরা নতুন করে রোগ এবং রোগের কারণ জানতে পারছি। মানসিক রোগগুলোও এরকম। মানসিক নতুন নয়, এ রোগ ছিলো, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নয়নে এখন প্রায় সকল রোগের উন্নত চিকিৎসা আবিষ্কার হয়েছে। মানসিক রোগের চিকিৎসা ও এখন অনেকদূর এগিয়ে গেছে। পূর্বের অবৈজ্ঞানিক, অপচিকিৎসার পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে সাইকিয়াট্রিস্টের মাধ্যমে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি। দেশে গড়ে উঠেছে মানসিক হাসপাতাল ক্লিনিক। আশার কথা দেশে অনেক বিশেষজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট বা মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ কাজ করে যাচ্ছেন নিরলস।
দেশের জনসংখ্যা হিসেবে চাহিদার তুলনায় সাইকিয়াট্রিস্ট অনেক কম। ফলে এখনো দেশের অনেক জায়গায় মানসিক রোগীরা নানা প্রকার দৈহিক মানসিক নির্যাতন মুলক, অপমান কর অশোভন সব অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। মানসিক রোগ বিষয়ে আমাদের অসেচতনতাও এক কারণ। প্রায় সব পরিবারেই কমবেশ স্বল্পতর বা ঘোরতর মানসিক রোগ রয়েছে। কিন্তু স্রেফ লজ্জা বা সামাজিক কুসংস্কার থেকে অনেকেই চিকিৎসার জন্যে আসেন না। আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বা মূর্খতা হলো মানসিক রোগী বা পরিবার নিয়ে আমরা ঠাট্টাতামাসা করি।
আমাদের দেশে প্রচলিত ঘোরতর বা স্বল্পতর মানসিক রোগের কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি:
১) ঝাটা পিটা- কবিরাজ বা ভন্ড ডাক্তার ঝাড়ু দিয়ে রোগীকে অনবরত পিটাতে থাকে।
২) সুই পুড়া- সুই আগুনে গরম করে রোগী বা রোগিণী কানে অথবা স্পর্শকাতর স্থানে ছিদ্র করে দেয়।
৩) লালা পড়া- রোগী সারা গায়ে লালা মেখে দেয়। সাধারণত বয়:সন্ধিক্ষণে কিশোরীর হালকা মানসিক সমস্যা হলে ভন্ড বাবা বা সাধুরা এটা করে।
৪) মরিচ পুড়া- মরিচ কে আগুনে পুড়িয়ে নাকে ঢুকিয়ে দেয়।
৫) বস্তা বান্দা- মানসিক রোগী কে বস্তায় পুরে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটাতে থাকে।
৬) মুত পড়া- ভন্ড বাবা নিজের পশ্রাব কে বোতলে ভরে দিনে তিন বার খেতে দেয়।
৭) ধোঁয়া বান- রোগী কে বদ্ধ ঘরে ধোঁয়ায় বেধে রাখা।
৮) চ্যাংদোলা- রোগী কে ন্যাংটি পরিয়ে চ্যাংদোলা করে রেখে পিটাতে থাকা। সাধারণত ভুয়া মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভন্ড গ্রাম ডাক্তার রা এটা করে।
৯) তেল পড়া- তেলের মধ্যে মরিচ মিশিয়ে গায়ে মাখতে দেয়া।
১০) ডান্ডা বেড়ি পরানো- রোগী কে সারা গায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে ফেলে রাখা।
১১) ধর্ষণ- রোগিণী কে নিজের ঘরে বা ডেরা তে আটকে রেখে অলৌকিক আত্মার হাজিরার কথা বলে ভন্ড বাবারা নিজেরাই রাতের পর রাত ধর্ষন বা ফিজিক্যাল এব্যুউজ করে।
১২) আংটি বা পাথর লাগানো-
কিছু কিছু ভন্ড রয়েছে দুষ্প্রাপ মেটাল বা রেডিও একটিভ ধাতু দ্বারা তৈরি আংটি বা প্রাকৃতিক কিছু রংবেরং পাথরের রহস্যময় ক্ষমতা বলে মানসিক রোগ সেরে যাবার কথা দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়। সাধারণত স্বল্পতর মানসিক রোগ যেমন হতাশা বিষণ্ণতা উদ্বিগ্নতা এরকম রোগী কেই তারা টার্গেটে করে। কঠিন, তরল বায়বীয় ধাতুর তৈরি আংটি দিয়ে রোগ সারালে বা ভাগ্য বদলালে খ্যাতিমান বিজ্ঞানী নিউটন আইনস্টাইনরা গলায় হাতে পায়ে সারাক্ষণ জ্বলমলে আংটি পরে বসে থাকতেন।
যাহোক আরো কিছু অপচিকিৎসা কথা শুনা যায় যার মধ্যে আছে মাথা মুড়িয়ে দেয়া, গরু ছাগলের সাথে বেঁধে রাখা, খেতে না দেয়া, ভারী কাজ করানো, গোবর বিস্টা খেতে দেয়া, সহ আরও অনেক কুকর্ম যা ভন্ড বাবা সাধু কবিরাজরা সবার সামনেই করে থাকে।
এসব চিকিৎসায় কি রোগী আদৌ ভালো হয়?
কেবল অশিক্ষিত নয় অনেক উচ্চ শিক্ষিতের বদ্ধমূল ধারণা যে এসব দৈহিক নির্যাতন মূলক, অপমান কর অপচিকিৎসায় মানসিক রোগ তাৎক্ষণিক সেরে যায়। আসলে বিষয়টি মোটেই সেরকম না। মুলত এসব নির্যাতন সইতে না পেরে রোগী তাৎক্ষণিক ভাবে স্বল্প বা দীর্ঘ সময়ের জন্যে সাব কনসাস বা আনকনসাস (অজ্ঞান) হয়ে পড়ে থাকে। তখন ভন্ডরা সেটাকে দেখিয়ে বলে রোগী গায়ে যা ভুত বা উপরি বাতাস ভর করেছিলো এখন সেটা চলে গেছে।
এগুলোর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলে না কেনো?
এ প্রশ্নের অনেক গুলো উত্তর আছে। প্রথমত হলো অজ্ঞতা, অসেচতনতা। এগুলো যে অপচিকিৎসা এটাই অনেকে বিশ্বেস করেন না। মানসিক রোগ ও মানসিক রোগ সম্পর্কে এখনও আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী অন্ধকারে রয়েছেন। ফলে ভন্ডরা ব্যবসা ফেঁদে মোক্ষম সুযোগ কাজে লাগিয়েছে। দ্বিতীয়ত এই সব ভন্ডদের অনেক সময় উপরে বিভিন্ন মহলের সাথে থাকে যোগাযোগ ও লেনদেন। তাদের রয়েছে বিশাল নেটওয়ার্ক। দালাল চক্র,ও মাদকাসক্তদের সাথে যোগাযোগ ফলে এদের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলে বা করতে গেলে নানান চাপের মধ্যে পড়তে হয় এমনকি প্রান নাশের মুখোমুখি হতে হয় অনেককে।
ভুক্তভোগী পরিবার কেনো এদের বিরুদ্ধে কিছু বলে না?
যেহেতু ভুক্তভোগী নানা রুপ শারিরীক ও আর্থিক ক্ষতির বা অপমানের শিকার হয় তাই লোক লজ্জার ভয়ে এসব আর বলতে যায় না। অনেকে অবশ্য বলেন অভিযোগ করে লাভ হয় না, বরং উল্টোটাই হয়।
এ থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়?
এসব অপচিকিৎসায় রোগী শারিরীকভাবে নির্যাতিত, ধর্ষিত এমন কি মারা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। এসব থেকে রেহাই পেতে হলে এসব ভন্ড বাবা, সাধু ও তাদের চিকিৎসালয় বা আখড়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে। এদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধাভোগীদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে। এমন কী ভন্ড বাবা বা সাধুদেরকেও মানসিক চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। কেননা অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ভন্ড বাবা বা সাধু সন্যাসীরাও ঘোরতর মানসিক বিকারগ্রস্থ।
মানসিক রোগ ডায়বেটিস প্রেশার বা হাঁপানি রোগের মতই একটা ব্রেইনের রোগ। ব্রেইনের কিছু নিউরোট্রান্সমিটারের স্বল্পতা বা আধিক্যের জন্যে এটা হয়। সাইকিয়াট্রিস্ট বা ব্রেইন ও মানসিক রোগের ডাক্তার দিয়েই এর চিকিৎসা করতে হয়। ভন্ড বাবা-মা, সাধু-সন্যাসী দিয়ে নয়। দেশ অনেক এগিয়েছে। এগিয়েছে চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা।
সাইকিয়াট্রি সাবজেক্টটি কঠিন হলেও এখন দেশে অনেক ডাক্তার এ সাবজেক্টে উচ্চতর পড়াশোনা করতে আগ্রহী হচ্ছেন। ইতিমধ্যে অনেক বিশেষজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্ট সারা দেশের মেডিকেল কলেজে রয়েছেন। তবে জনসংখ্যা ও রোগী হিসেবে দেশের জন্যে আরও প্রচুর সাইকিয়াট্রিস্ট প্রয়োজন রয়েছে। যারা আছেন তাদের উপর রয়েছে প্রচুর চাপ।
আসুন মানসিক রোগীকে নির্যাতন বা অবহেলা নয়। অশিক্ষিত মূর্খের মতো মানসিক রোগ নিয়ে লজ্জা, ঠাট্টা তামাশাও নয়।
ডা. মুহাম্মাদ সাঈদ এনাম ওয়ালিদ
চিকিৎসক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কলামিস্ট, জনস্বাস্থ্য গবেষক।