আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পরের দিন ঘুম থেকে উঠে বিশ্ব জানতে পারে যে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হয়েছেন। কিন্তু ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জোসেফ আর. বাইডেন জুনিয়রের ফলের জন্য পরের শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়নি।
তবে আগামী ৫ নভেম্বরের নির্বাচনের ফল কখন জানা যাবে, তা নির্ভর করছে অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেমন তীব্র হবে তার ওপর। কিছু রাজ্যে যদি ভোটের ব্যবধান কয়েক হাজারে নেমে আসে তাহলে হয়তো ২০২০ সালের মতোই পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু একজন প্রার্থী যদি নির্বাচনে ব্যাপক ব্যবধানে এগিয়ে থাকেন, তাহলে ফলাফল আরও আগে পরিষ্কার হয়ে যেতে পারে। তবে এ বছরের নির্বাচনে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রিপাবলিকান দলীয় ডোনাল্ড ট্রাম্প আর ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমালা হ্যারিসের মাঝে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস রয়েছে।
• কী ঘটেছিল ২০২০ সালে?
২০২০ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৩ নভেম্বর (মঙ্গলবার)। দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল নির্ধারণী সাত রাজ্য—অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, উত্তর ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনের ফলের জন্য পরের দিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল।
মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) বুধবার মিশিগান এবং উইসকনসিন রাজ্যে জো বাইডেনে বেশিসংখ্যক ইলেক্টোরাল কলেজ পেতে পারেন বলে ধারণা দিয়েছিল। আর এই দুই রাজ্যের নির্বাচনী ফলই ইলেক্টোরাল কলেজের সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় বাইডেনকে। এছাড়া ডাকযোগে দেওয়া ভোট গণনা করার জন্য নির্বাচনের ফল জানতে আরও তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ভোট গণনায় অতিরিক্ত সময়ের দরকার হয়েছিল সেই সময়।
পরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার চারদিন পর ৭ নভেম্বর শনিবার পর্যন্ত চূড়ান্ত ফলের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। পেনসিলভানিয়ায় জো বাইডেনের জয়ের সাথে সাথে দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নিশ্চিত হয়ে যান ডেমোক্র্যাট দলীয় এই প্রার্থী। নেভাদা, জর্জিয়া, অ্যারিজোনা এবং উত্তর ক্যারোলিনায় আরও পরে ফল ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল শনিবার দুপুরের কিছুক্ষণ আগেই জানা যায়।
• ভুল ছিল কিছু?
না। যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে বলে দাবি করেছিলেন। তবে তাতে নির্বাচনী ফলে কোনও পরিবর্তন আসেনি। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার মিত্ররা এবারও একই ধরনের অভিযোগ তুলতে পারেন। ভোটের প্রাথমিক ফল অসম্পূর্ণ থাকায় চূড়ান্ত ফল জানতে কয়েক দিন সময় লেগেছিল। তবে আমেরিকানরা ২০০০ সালের আগে পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনের ফল ভোটের দিন রাতেই জানতে পারতেন। আধুনিক মার্কিন নির্বাচনে ভোট গণনা কখনই একদিনে শেষ হয়নি।
কোভিড মহামারীর আগে দ্য অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের মতো বার্তা সংস্থাগুলোর কাছে সাধারণত নির্বাচনের রাতে কে জিতেছে তা জানানোর জন্য যথেষ্ট তথ্য থাকতো। ভোট গণনায় বড় পরিবর্তন ঘটে ২০০০ সালে। ওই সময় ডাক যোগে ভোটদানের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কারা এই সুবিধা পাচ্ছে সেই বিষয়ে পক্ষপাতমূলক বিভাজন থাকায় ভোটের রাতেই চূড়ান্ত ফল জানার মতো তথ্য সংবাদমাধ্যমগুলোর কাছে থাকে না।
• কখন জানা যাবে ফল?
সাতটি সুইং রাজ্যের ভোট; যা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দৌড়ে কে এগিয়ে তা নির্ধারণ করবে। এই সাত রাজ্যের ভোটগ্রহণ শেষ হবে ৫ নভেম্বর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে।
ভোটের রাত কেমন যাচ্ছে তার প্রথম ইঙ্গিত পাওয়া যাবে জর্জিয়ায় সন্ধ্যা ৭টা এবং উত্তর ক্যারোলিনায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর। তবে কমালা হ্যারিস যদি সুইং রাজ্যগুলোতে ভালো ফল করেন তাহলে মিশিগান, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনের মতো রাজ্যগুলোর ফল পেতে ডেমোক্র্যাট শিবিরকে অপেক্ষা করতে হবে না। বিপরীতে ট্রাম্প যদি দক্ষিণের যুদ্ধের ময়দানেও জয়ী হন তাহলেও কমালা হ্যারিসের জয়ের পথ প্রশস্ত থাকবে। তবে চূড়ান্ত ফলের জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
মিশিগান এবং পেনসিলভেনিয়ায় ভোট শেষ হয় রাত ৮টায়, উইসকনসিন ও অ্যারিজোনায় রাত ৯টা এবং নেভাদায় রাত ১০টায়।
• ইলেক্টোরাল কলেজে নির্ধারণ হবে ফল
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা ৫ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দেবেন। দেশটির বেশিরভাগই হয় ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমালা হ্যারিস অথবা রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভোট দেবেন। তবে তাদের দু’জনের মধ্যে কে জয়ী হবেন, সেটা ভোটারদের দেওয়া ভোটে সরাসরি নির্ধারিত হবে না। জাতীয় স্তরের নির্বাচনী লড়াইয়ের বদলে জয়ী-পরাজিত নির্ধারিত হবে; একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটিতে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সবকটি ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোট পেয়ে যাবেন।
ইলেকটোরাল কলেজের মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। মাইন ও নেব্রাসকা এই দু’টি অঙ্গরাজ্য বাদে বাকি সবগুলো রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট যোগ দিলে যে প্রার্থী ২৭০টি বা তারও বেশি ভোট পাবেন তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।
সেই প্রার্থীর রানিং মেট হয়ে যাবেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট।
• কীভাবে কাজ করে ইলেক্টোরাল কলেজ?
প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটি করে ইলেক্টোরাল ভোট থাকে; যা ওই অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার সমানুপাতিক হয়। ক্যালিফোর্নিয়ায় সর্বাধিক ৫৪টি, এবং ভায়োমিং, আলাস্কা এবং নর্থ ডাকোটা এবং ওয়াশিংটন ডিসির মতো যেসব অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যা খুবই কম, সেখানে অন্তত তিনটি ইলেক্টোরাল ভোট আছে।
সাধারণত অঙ্গরাজ্যগুলো তাদের হাতে থাকা ইলেক্টোরাল ভোট সেই প্রার্থীকেই দেয়, যিনি ওই অঙ্গরাজ্যের ভোটারদের সরাসরি ভোটে জয়ী হয়েছেন। ধরা যাক, টেক্সাসে একজন প্রার্থী ভোটারদের সরাসরি ভোটের ৫০.১ শতাংশ পেয়েছেন, তখন ওই অঙ্গরাজ্যের হাতে থাকা ৪০টি ইলেক্টোরাল ভোটের সবগুলোই সেই প্রার্থী পেয়ে যাবেন। একটি অঙ্গরাজ্যে জয়ের ব্যবধান যদি বিরাট হয়ও, তাহলেও জয়ী প্রার্থী সেসব ইলেক্টোরাল ভোটই পাবেন।
• সুইং স্টেট
বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যই প্রতিটা নির্বাচনে ধারাবাহিকভাবে একই দলকে ভোট দিয়ে আসে। আমেরিকান নির্বাচনে রিপাবলিকান দুর্গ বলে পরিচিত এই অঙ্গরাজ্যগুলোকে বলা হয় রেড স্টেট বা লাল রাজ্য। আর ডেমোক্র্যাটদের প্রাধান্য পাওয়া স্টেটগুলোকে বলা হয় ব্লু স্টেট বা নীল রাজ্য।
ফলে এসব রাজ্য নিয়ে প্রার্থীদের খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না বা মনোযোগ দিতে হয় না। কিন্তু হাতে গোনা কিছু অঙ্গরাজ্য আছে যে রাজ্যগুলোর ভোট, প্রার্থীদের কারণে যে কোনও শিবিরে যেতে পারে।
ফলে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা নির্দিষ্ট কিছু সুইং স্টেটের দিকে নজর দেন যেখানে ভোট কোন পার্টির পক্ষে যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বোঝা যায় না। এগুলোই হল আমেরিকান নির্বাচনের ব্যাটলগ্রাউন্ড বা নির্বাচনী রণক্ষেত্র। এগুলোকেই অনেকে বলে থাকে বেগুনি রাজ্য।
প্রার্থীদের কাছে এসব অঙ্গরাজ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যেগুলোকে বলা হয় ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট বা নির্বাচনী রণক্ষেত্র। আর এই অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোটই শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় জয় পরাজয়ের মূল চাবিকাঠি। এই রাজ্যগুলোতেই হয় মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যগুলো ২০১৬ সালে এভাবেই ব্যাটল-গ্রাউন্ড স্টেট হয়ে উঠেছিল। প্রত্যেক নির্বাচনের সময় দেখা গেছে যেসব রাজ্যের ভোট বেশি, প্রার্থীরা সেসব রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারণার পেছনে অনেক বেশি সময় ও অর্থ ব্যয় করে থাকেন।
সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, বিবিসি, ওয়াশিংটন পোস্ট।