নিজস্ব প্রতিবেদক
ভারতীয় বিচ্ছিন্নতবাদী সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর সদস্য যারা মিয়ানমারে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং সেখানকার গৃহযুদ্ধে লড়াই করেছেন; তারা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের সহিংসতায় বিধ্বস্ত মণিপুর রাজ্যে ফিরছেন। যুদ্ধের কঠিন প্রশিক্ষণ নেওয়া এসব সদস্য চলতি বছর ফেরায় মণিপুর রাজ্যের ১৯ মাসের তিক্ত জাতিগত সংঘাত আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে শুক্রবার ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে।
রয়টার্স বলছে, মিয়ানমার থেকে যোদ্ধারা ফেরায় মণিপুরের প্রভাবশালী ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতি সম্প্রদায় এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কুকি উপজাতিদের মধ্যে সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সমালোচকরা বলছেন, মণিপুরের এই সংঘাত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ১১ বছরের সরকারের সবচেয়ে বড় আইন-শৃঙ্খলা ব্যর্থতা। ২০২৩ সালের মে থেকে শুরু হওয়া এই সংঘাতে মণিপুরে অন্তত ২৬০ জন নিহত হয়েছেন। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও ৬০ হাজারের বেশি মানুষ।
ভারতীয় সামরিক বাহিনীর ও পুলিশের ৯ জন কর্মকর্তার পাশাপাশি মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও বিদ্রোহী সূত্রের সঙ্গে কথা বলেছে রয়টার্স। প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর সশস্ত্র সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে মিয়ানমার থেকে মণিপুরে চলে আসায় সংঘাত নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে বলে তারা জানিয়েছেন।
এই গোষ্ঠীগুলোর যোদ্ধারা রকেট লঞ্চারসহ অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। মণিপুরে সংঘাতে কেবল গত নভেম্বরেই অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছেন। সহিংসতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার মণিপুরে আরও ১০ হাজার সৈন্য ও ৩০ হাজার পুলিশ মোতায়েন করেছে। এর ফলে সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের মোতায়েন করা সৈন্যের সংখ্যা ৬৭ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
মণিপুরের পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্র ক্রয় ও অভিযান পরিচালনার ব্যয় মেটানোর জন্য অপরাধ সংঘটনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা ব্যাপক বেড়েছে।
রাজ্য পুলিশের সাবেক প্রধান কর্মকর্তা ও ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মণিপুরের উপ-মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা ইউমনাম জয়কুমার সিং বলেন, ‘‘প্রায় ১০ বছর আগে আমরা যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম, তারা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।’’
মণিপুরে ২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে কট্টরপন্থী পুলিশ প্রধান হিসাবে মেইতি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা করেছিলেন তিনি। জয়কুমার সিং বলেন, ‘‘তাদের মধ্যে কেউ কেউ মিয়ানমার থেকে ফিরে আসছেন, কেউ কেউ ইতোমধ্যে চলেও এসেছেন।’’
এই বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মণিপুর পুলিশ এবং মিয়ানমারের জান্তা মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি বলে জানিয়েছে রয়টার্স। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর মূলত পার্বত্য এলাকা। মিয়ানমারের সীমান্ত লাগোয়া এই বনভূমি অঞ্চলে ৩২ লাখ মানুষের বসবাস রয়েছে।
গত বছর দেশটির একটি আদালত ইম্ফল উপত্যকা অঞ্চলে বসবাসকারী মেইতিদেরকে ঐতিহাসিকভাবে সুবিধাবঞ্চিত কুকিদের মতো একই সরকারি সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ওই বছরের ৩ মে ইম্ফল হাইকোর্ট মণিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতিদের সাংবিধানিকভাবে তফসিলি জাতি মর্যাদা দিতে কেন্দ্রীয় সরকার বরাবর সুপারিশ করেন। মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ মেইতি জনগোষ্ঠীর।
হাইকোর্টের এই সুপারিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে রাজ্যের অপর জনগোষ্ঠী কুকি। মণিপুরে মোট জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ এই জাতিগোষ্ঠীর। আদালতের আদেশের অল্পসময়ের মধ্যেই শুরু হওয়া বিক্ষোভ জাতিগত দাঙ্গায় রূপ নেয়। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী সহিংসতার লাগাম টানার চেষ্টায় দুই গোষ্ঠীর মাঝে একটি ‘বাফার জোন’ তৈরি করেছে।
ভারতের এই রাজ্যে বিদ্রোহের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। গত কয়েক দশকে বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীর অভিযানের সময় উন্মুক্ত সীমান্ত পেরিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অনেক সদস্য পালিয়ে যান।
• কারা কার পক্ষে
রাজ্যের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেছেন, মেইতি জনগোষ্ঠীর সদস্যরা মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে শাসক জান্তার পক্ষে লড়াই করছেন এবং চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের অন্তত ২ হাজার যোদ্ধা মণিপুর থেকে সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছেন।
তারা উত্তর মিয়ানমারের সাগাইং, কাচিন ও চিন এলাকায় পিপলস ডিফেন্স ফোর্স- কালে (পিডিএফ-কে) এবং কুকি ন্যাশনাল আর্মির মতো জান্তা-বিরোধী বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই করেছেন বলে ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও উপজাতি নেতারা জানিয়েছেন।
ভারতীয় তিনজন কর্মকর্তা, কয়েকজন উপজাতি নেতা ও মিয়ানমারের পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের একটি সূত্রের মতে, কাচিন বিদ্রোহীদের প্রতি সমর্থন রয়েছে কুকিদের। মিয়ানমারের আধা-স্বায়ত্তশাসিত ওয়া রাজ্য থেকে অস্ত্র কিনছেন এই কুকিরা।
মিয়ানমারের চিন রাজ্যের জান্তা-বিরোধী বিদ্রোহী সংগঠন ন্যাশনাল ফ্রন্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুই খার বলেন, কিছু মেইতি জনগোষ্ঠী সেনাবাহিনীর সহায়তায় মিয়ানমারের শিবিরগুলোতে কাজ করছেন। কিন্তু তারা বর্তমানে সীমান্তের আশপাশের এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে অবস্থান নিয়েছেন এবং মণিপুরে ফিরে যাচ্ছেন।
টেলিফোনে রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘‘এই মেইতিরা আমাদের বিরুদ্ধে অভিযানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করেছেন।’’ ভারতীয় সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, মণিপুরে ফিরে আসা সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঠিক সংখ্যা জানা কঠিন।
ভারতের একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তার মন্তব্য ও সরকারি তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, গত বছর মিয়ানমার থেকে মণিপুরের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় মেইতি সম্প্রদায়ের শতাধিক সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া চলতি বছরে সীমান্তে আরও ২০০ জনেরও বেশি মেইতি সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই সময়ে প্রায় ৫০ কুকি বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত অক্টোবরে ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী বলেছিলেন, ‘‘মণিপুর একটি সমস্যা এবং বর্তমানে সেখানে মিয়ানমারের সমস্যাও আসছে। লড়াইয়ের পথ কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে।’’ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারের সঙ্গে নিজেদের এক হাজার ৬০০ কিলোমিটার সীমান্তে বেড়া দেওয়ার পরিকল্পনার ঘোষণা দেয় ভারত।
• চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা
মণিপুরের প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর যোদ্ধারা বর্তমানে রকেট লঞ্চার, মেশিনগান, স্নাইপার এবং অ্যাসল্ট রাইফেলে সজ্জিত। ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মণিপুর পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এসব অস্ত্রের মধ্যে বিদেশে তৈরি এম১৬এস, এম৪এ১এস ও একে-৪৭ রাইফেলও রয়েছে।
দেশটির কর্মকর্তারা বলেছেন, মণিপুরে ব্যবহৃত অনেক অস্ত্র সংঘাতের গোড়ার দিকে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রাগার থেকে লুট করা হয়েছিল। এছাড়া চলতি বছরে মিয়ানমার থেকে আরও অত্যাধুনিক অস্ত্র আনা হয়েছে।
২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে ভারতের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন গৌতম মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, মণিপুরে মূলত দুটি স্বতন্ত্র দ্বন্দ্ব রয়েছে। এর মধ্যে একটি সামরিক শাসন থেকে স্বাধীনতার দাবিতে এবং অন্যটি অভ্যন্তরীণ জাতিগত সংঘাত; যা ব্যাপকভাবে এক পক্ষের সঙ্গে অন্য পক্ষের।
গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এক পক্ষের বিরুদ্ধে অপর পক্ষের সংঘাত চলছে। যে কারণে সেখানে কিছু অস্ত্রের হাতবদল ঘটছে এবং ব্যবসা হচ্ছে বলে ধারণা করা যায়।’’
রাজ্যের গ্রেপ্তারকৃত বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, মণিপুরের মেইতি-অধ্যুষিত উপত্যকা এলাকায় প্রায় দেড় হাজার এবং কুকি অধ্যুষিত পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় ২ হাজার অস্ত্র অবৈধভাবে আমদানি করা হয়েছে।
এছাড়াও মেইতি গোষ্ঠীর সদস্যরা আরও প্রায় ৫ হাজার সরকারি অস্ত্র লুট করেছেন। অন্যদিকে কুকিরা প্রায় এক হাজার সরকারি অস্ত্র লুট করেছেন বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। গত নভেম্বরে মণিপুরের সরকারি কর্মকর্তারা গণমাধ্যমকে জানান, এখন পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ ৩ হাজার অস্ত্র উদ্ধার করেছে; যার মধ্যে লুট হওয়া প্রায় ২ হাজার অস্ত্রও রয়েছে।
নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেছেন, মণিপুরের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর চাঁদাবাজি ছাড়াও অস্ত্রের জন্য কিছু অর্থ আসে অবৈধ পপি চাষ থেকে; গত কয়েক বছর ধরে রাজ্য সরকার পপি চাষ বন্ধ করার চেষ্টা করেছে।
ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ট্রাইবাল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হোমেন থাংজাম বলেন, ‘‘পপির খামার পাহাড়ে। কিন্তু প্রক্রিয়াজাতকরণ উপত্যকায়ও হয়। আমরা দেখেছি, সেখানে মাঠপর্যায়ের শ্রমিকদের নিরাপত্তা দেন সশস্ত্র ব্যক্তিরা; তারা যে সম্প্রদায়েরই শ্রমিক হন না কেন। কে তাদের অর্থায়ন করেন তা একটি রহস্য।’’