ক্লাসে একেবারে সবার সামনের যে বেঞ্চ, সেটাতে গিয়ে সব সময় বসেন তাঁরা। ফি-বছর বার্ষিক পরীক্ষা শেষে দেখা যায়, তাঁদের মধ্যেই কারও রোল নম্বর এক হয়েছে, তো অন্যজনের দুই কিংবা তিন। কিন্তু করোনাকালে সবকিছুতে ঝিম ধরে যাওয়ার বেলাতে তাঁদেরও বুঝি পড়ায় ফাঁকি দেওয়ার ইচ্ছা হলো! বার্ষিক পরীক্ষা শেষে দেখা যাচ্ছে, তাঁদের ছাপিয়ে দ্বিতীয়-তৃতীয় বেঞ্চে থাকা একজন ক্লাসে প্রথম হয়ে যাওয়ার পথে। কারও কারও তো মোটামুটি পঞ্চাশ-ষাট পেয়ে বার্ষিক পরীক্ষা পার করে যেতেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে!
গল্পটা ইউরোপিয়ান ফুটবলের ‘সামনের বেঞ্চির ছাত্র’দের এবারের মৌসুমের। বার্ষিক পরীক্ষা এখানে দেশে দেশে লিগ কিংবা ইউরোপের ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের মঞ্চ চ্যাম্পিয়নস লিগ। বার্সেলোনা, রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা পিএসজি, জুভেন্টাস…প্রতিটা মৌসুমের শেষেই এঁদেরই শিরোপার উল্লাস দেখে অভ্যস্ত ইউরোপের ফুটবলে বুঁদ চোখ। কখনো হয়তো এক-দুজনের একটু খারাপ যায় সময়, কিন্তু একসঙ্গে সামনের সারির প্রায় সব ছাত্রছাত্রীর সময় খারাপ যাবে? করোনাকাল সেটিও দেখিয়ে দিল। প্রথম সারির ক্লাবগুলোর বদলে দ্বিতীয়-তৃতীয় সারির ক্লাবেরই যে শিরোপার উল্লাস দেখছে এবারের ইউরোপের ফুটবল মৌসুম।
এ মৌসুমে অনেক ম্যাচ শেষেই এমন মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়তে হয়েছে সের্হিও রামোসদের।
ছবি: রয়টার্স
চশমা পরা, চুল সোজা করে লেপ্টে রাখা, বাবা-মায়ের কথা শোনা সুবোধ বালকের মতো এবারও ক্লাসে ‘নিজ সেকশনে প্রথম’ হওয়ার গর্ব ধরে রাখা গুটিকয় ছাত্র যে নেই, তা নয়। ছাঁকনি দিয়ে ছেকে নিন। বায়ার্ন মিউনিখ, ম্যানচেস্টার সিটি নাম দুটি বাদ পড়বে। ইউরোপের শীর্ষ লিগের ব্যপ্তিটা ইংল্যান্ড, স্পেন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স থেকে আরেকটু ছড়িয়ে দিলে আয়াক্সের নামটাও আসবে। এই তিনটি ক্লাব নিজেদের লিগে এবার সেরা।
বায়ার্ন তো জার্মান লিগকে ‘পৈতৃক সম্পত্তি’ জ্ঞান করে এবার জিতল টানা নবমবারের মতো। আয়াক্সেরও তা-ই, পাঁচ ভূতে লুটে খাওয়ার মতো করে গত এক দশকে সম্পত্তিটার ভাগ অন্যরা নিয়ে নিয়েছিল আর কী! তবে এখন আবার দখল ফিরিয়ে এনেছে ক্লাবটা। গত মৌসুমে করোনার কারণে লিগ বাতিল না হলে তারাই হয়তো জিতত, কিন্তু সেটি বাদ দিলেও তার আগের মৌসুমের মতো এবারও ডাচ লিগ এরদিভিসির শিরোপা আয়াক্সের—লিগের ইতিহাসে আয়াক্সের ৩৫ শিরোপার ‘নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী’ পিএসভি আইন্দহফেনের শিরোপা ২৪টি। ইংল্যান্ডে অবশ্য শিরোপার ক্ষেত্রে ‘বিধি তুমি বলে দাও শিরোপা কার’ নীতি চলার দাবি করেন ইংলিশ ফুটবলের সমর্থকেরা, স্পেন-জার্মানি-ফ্রান্স-ইতালির দিকে তাকালে এত দিন দাবিটা সত্যি বলেই মনে হতো। কিন্তু ইংল্যান্ডেও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবস্থা খুব একটা সুবিধার না! ম্যানচেস্টার সিটি এবার নিয়ে গত চার মৌসুমে তিনবার লিগ জিতল!
নেইমার–ডি মারিয়ারা এবারও হতাশা নিয়েই শেষ করেছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ অভিযান।
ছবি: রয়টার্স
বেলজিয়ামের লিগ ধরলেও অবশ্য একটু চেনা চিত্রের দেখা মিলবে। ওই লিগটাতে অ্যান্ডারলেখট আর ক্লাব ব্রুজই হচ্ছে বেলজিয়ান, রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনা। মাঝে গেঙ্ক একবার ‘আতলেতিকো মাদ্রিদ’ হয়ে ২০১৮-১৯ মৌসুমে শিরোপা জিতেছিল, এর বাইরে গত এক দশকে এই দুই ক্লাবের কাছ থেকে কেউ শিরোপা নিতে পারেনি। এবারও অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন ব্রুজ এবারও জিততে যাচ্ছে লিগ।
কিন্তু এই তিন-চারটি ক্লাবের শিরোপা জয়ই এবার যেন চিত্রনাট্যের ব্যতিক্রম। না হলে কি স্পেন, কি ফ্রান্স, কি পর্তুগাল, কি ইতালি, কি স্কটল্যান্ড…ইউরোপের ফুটবলে এবার রোমাঞ্চ ডালপালা ছড়িয়ে গেল। এখনো রিয়াল মাদ্রিদের স্প্যানিশ লিগ জেতার সম্ভাবনা আছে, এমনকি বার্সেলোনাও (যদিও পাঁড় বার্সা সমর্থকও এখন আর সে আশা করে বুক ভারী করার কথা নয়), পিএসজি জিততে পারে ফরাসি লিগ…কিন্তু সম্ভাবনার হিসাবে বাস্তবের বোধের চেয়ে কাগজে-কলমের আনুষ্ঠানিকতার প্রভাব বেশি।
স্পেনেই দেখুন! আতলেতিকো সেখানে শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে গত এক দশকে, তা-ও এই এক দশকে তারা শিরোপা জিতেছে একবার। বাকি সময় বার্সাই বেশি জিতেছে, ফাঁকফোকরে রিয়াল মাদ্রিদ জিতেছে তিনবার। কিন্তু এবার? আতলেতিকো আবার শিরোপার হাতছোঁয়া দূরত্বে। মাঠে-মাঠের বাইরে কয়েক মৌসুম ধরে আরও নড়বড়ে হয়ে পড়া বার্সা পালাবদলের মধ্য দিয়ে যাওয়া মৌসুমে গত সপ্তাহ পর্যন্তও শিরোপার সম্ভাবনায় যে ছিল, এ জন্য নিজেদের পিঠ চাপড়ে দিতে পারে। আর রিয়াল মাদ্রিদ? খেলোয়াড়েরা এবার মাঠের চেয়ে যেন হাসপাতালে বেশি সময় কাটিয়েছেন।
এর মধ্যেও এই মুহূর্তে লিগে দ্বিতীয় রিয়ালের পয়েন্ট ৩৬ ম্যাচে ৭৮। শীর্ষে থাকা আতলেতিকোর ৮০। লিগের আর দুটি করে ম্যাচ বাকি, তাতে বার্সা এখনো কাগজে-কলমের কিছু জটিল হিসাবে সম্ভাবনার দৌড়ে আছে, ৩৬ ম্যাচে ৭৬ পয়েন্ট নিয়ে মেসিরা আছেন তিন নম্বরে। কিন্তু সব হিসাব শিরোপাটাকে যেন আতলেতিকোর দিকেই যেতে দেখায়। সাত বছর পর আবার মাদ্রিদে সাদা নয়, হবে লাল-সাদা উল্লাস।
এখানে তো তবু রিয়াল-বার্সা দুটি দল ভাগাভাগি করেছিল, ফ্রান্স আর ইতালিতে কী হলো? দুর্গপতন! পিএসজির এখনো সম্ভাবনা আছে লিগ জেতার ঠিকই, কিন্তু আর দুই ম্যাচ বাকি থাকা লিগ যত শেষ ক্ষণের দিকে এগোচ্ছে, ততই দীর্ঘশ্বাস ভারী হয় নেইমার-এমবাপ্পের ভক্তদের। ৭৬ পয়েন্ট নিয়ে পিএসজি লিগে দ্বিতীয়, শীর্ষে থাকা লিলের পয়েন্ট ৭৯। মাঝে এমবাপ্পে-ঝলকে মোনাকোর চমক দেখানো ২০১৬-১৭ মৌসুম বাদ দিলে গত আট মৌসুমে সাতবার লিগ জেতা পিএসজির শিরোপা বুঝি এবার হাতছাড়া হয়ে গেল! শুধু লিগই কেন, ১৯ মে ফ্রেঞ্চ কাপের ফাইনালে না জিতলে গত এক দশকে এই প্রথম বড় কোনো শিরোপা ছাড়া মৌসুম শেষ হবে পিএসজির!
ইতালিতে যে দশা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জুভেন্টাসের। লিগে তাদের দৃশ্যত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ শেষ হয়ে গেল ৯ মৌসুম পর। ২০১১ সালে লিগটা জিতেছিল এসি মিলান, মাঝে এত বছর জুভের দাপটের পর সেটি এবার নিয়ে গেল ইন্টার মিলান। যে আন্তোনিও কন্তের হাত ধরে লিগে এই জুভেন্টাস দাপটের শুরু, সেই কন্তে ইন্টারের ডাগআউটে এসে জুভের দুর্গ ভাঙলেন! ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জন্য হতাশা আর কী! জুভেন্টাসকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানোর স্বপ্ন নিয়ে রিয়াল মাদ্রিদ ছেড়েছিলেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ তো জেতা হলোই না, তাঁর যাওয়ার আগেই লিগকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি বানিয়ে ফেলা জুভের সে সম্পত্তিও বেদখল। তা-ও কী, লিগে সেরা চারে থেকে জুভের আগামী মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলাই এখনো অনিশ্চয়তায় ঘেরা। জুভেন্টাসেরও একটা ভাগ্যপরীক্ষা আছে ১৯ মে, আতালান্তার বিপক্ষে সেদিন ইতালিয়ান কাপের ফাইনালে না জিতলে জুভেন্টাসও ১০ বছরে প্রথমবার মৌসুম কাটাবে শিরোপাহীন!
রোনালদোর নিজের দেশের লিগেও কি ভূমিকম্পের মাত্রা এবার কম ছিল নাকি! ধাক্কাটা দিয়েছে রোনালদোরই আঁতুড়ঘর স্পোর্টিং লিসবন। ২০০২-০৩ মৌসুমে ক্লাবটাতে অভিষেক হয়েছিল রোনালদোর, তার পরের মৌসুমেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে চলে গিয়েছিলেন। রোনালদোর অভিষেকের আগের মৌসুম, অর্থাৎ ২০০১-০২ মৌসুম শেষ লিগ জেতা লিসবন মাঝে এত বছর শুধু বেনফিকা আর পোর্তোকেই ‘পাস দ্য লিগ’ খেলতে দেখেছে। বেনফিকা জিতেছে, নয়তো পোর্তা। এবার ধারাটা ভেঙে দিয়েছে লিসবন! এরই মধ্যে তাদের লিগ জেতা নিশ্চিত হয়ে গেছে!
স্কটল্যান্ডে যে ধাক্কাটা দিয়েছে স্টিভেন জেরার্ডের রেঞ্জার্স! সেখানে ২০১১ সালের পর রেঞ্জার্সের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী সেল্টিকই লিগ জিতেছে প্রতিবার। রেঞ্জার্স এর মাঝে প্রশাসনিক কারণে অবনমিত হয়ে নিচের স্তর থেকে ঘুরে এসেছে, সেটিও সেল্টিকের এমন দাপটে ভূমিকা রেখেছে। তা যা-ই হোক, রেঞ্জার্সের কোচ হয়ে এই দাপট শেষ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া জেরার্ড এবার তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণে সফল! লিভারপুলের কিংবদন্তি অধিনায়ক এই রেঞ্জার্সকে দিয়েই কোচিং ক্যারিয়ারের শুরু করেছেন। দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছরে ধীরে ধীরে উন্নতি করতে থাকা রেঞ্জার্স এবার ২০১১ সালের পর আবার লিগ তো জিতেছেই, সবাইকে দুমড়েমুচড়ে দিয়েই জিতেছে! দুইয়ে থাকা সেল্টিকের চেয়ে ২৫ পয়েন্ট এগিয়ে লিগ শেষ করেছে। আর আজ অ্যাবারডিনকে ৪-০ গোলে গুঁড়িয়ে নিশ্চিত করল, রেঞ্জার্স অপরাজিত থেকে মৌসুম শেষ করছে!
এবার পাশেই ইংল্যান্ডেই আবার নজর ফেরান। জেরার্ডেরই সাবেক ক্লাব লিভারপুলেই নজর ফেরান। গত মৌসুমে দুর্দমনীয় দাপটে তিন দশকের লিগ শিরোপা-খরা ঘুচিয়েছে ইয়ুর্গেন ক্লপের দল। এর আগের দুই মৌসুমেও ম্যানচেস্টার সিটিকে শেষ দিন পর্যন্ত ধাওয়া করে গেছে লিগের দৌড়ে। কিন্তু এবার? চোটে এমনই জেরবার যে, লিভারপুলের লিগে সেরা চারে থেকে আগামী মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলাও নিশ্চিত নয়।
ওহ, শুধু লিগগুলোর কথা বলা হলো, চ্যাম্পিয়নস লিগের নাটক দেখবেন না?
ম্যানচেস্টার সিটি যে চ্যাম্পিয়নস লিগের দিকে তাকিয়ে ‘অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন’ গাইতে পারছে, নিজেদের ইতিহাসে এবার প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠল, মৌসুমের মাঝপথে পথ হারানোর শঙ্কায় থাকা চেলসি যে টমাস টুখেলের অধীনে ঘুরে দাঁড়িয়ে এখন ২০১২ সালের পর আবার ফাইনালে উঠে দ্বিতীয় চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপার স্বপ্ন দেখছে…এগুলোকে কি স্বাভাবিক মনে হয়?
অবশ্য করোনাকালে এবারের মৌসুমটাই এমন অস্বাভাবিক, সে হিসাবে এসবই হয়তো হওয়ারই ছিল!