ইফতেখায়রুল ইসলাম:
রাতে পড়তে পড়তে প্রচন্ড ক্ষুধা পেলে পানি খাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না ছেলেটি অথবা মেয়েটির! এছাড়া আর কোনো পথও নেই! টাকা না থাকলে মেস ভাড়া, খাবার খরচ, বুয়ার বেতন দেবে কি করে,তাই অতিরিক্ত কিছু খেতে চাওয়া তাঁদের কাছে বিলাসিতার নামান্তর। দয়া করে আশ্চর্য হবেন না, বিশ্ববিদ্যালয় অথবা কলেজে পড়ুয়া কারো কারো জীবনে এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিষয়!
আমাদের অনেকেরই বাসায় রাতে পড়ুয়া সন্তানের জন্য কত মুখরোচক নাশতা প্রস্তুত থাকে – অথচ অন্যদিকে অর্থাভাবে নিমজ্জিত ছেলে অথবা মেয়েটি বলেই দেয় রাতে আমার জন্য ( Meal- খাবার) রেখোনা দাওয়াত আছে! দাওয়াত তো নয় আসলে মিলের টাকাটুকুও পরিশোধের সাধ্য নেই!
গ্রাম থেকে উঠে আসা অতিশয় নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যটি যখন চরম প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে ঢাকায় পড়তে আসে, তখন তাঁর পাশে দাঁড়াবার মত আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত পরিবারের পক্ষে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবার আগ্রহী সন্তানের জন্য ভূমিকা পালনের সুযোগটুকুও থাকে না! অর্থাভাব এবং তা সত্ত্বেও শিক্ষা দীক্ষায় বড় হতে চাওয়া এই ছেলে মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ আবার দারুণ প্রখর হয়। এরা মরে যাবে তাও মাথা নীচু করবে না!
আপনি যদি প্রশ্ন করেন দুপুরে খেয়েছো কিছু? না খেয়েও বলবে খেয়েছি! তাঁদের অনেকেই আপনাকে কোনোভাবেই বুঝতে দেবেনা অর্থাভাবে কখনো দুই বেলা খাবারটুকুও ঠিকমত খাওয়া হয়না! কেউ গ্রাম থেকে ছাতু বানিয়ে নিয়ে আসে, কেউবা দুই টাকায় একটি বান রুটি কিনে সেটিকে পানিতে ভিজিয়ে রেখে একটু ভারী করে তারপর খায়, যেন পেট ভরে থাকে। কেউ খাওয়া শুরু করার আগে দুই,তিন গ্লাস পানি খেয়ে তারপর খাবার খায় যেন অল্প খেলেই পেট ভরে যায়…!
তাঁদের পরিবারের সংগতি আছে শুধু খাদ্যের ও বাসস্থানের ; উচ্চশিক্ষার ক্ষুধাটুকু নিবৃত্ত করার সাধ্য ও ক্ষমতা তাঁদের অনেকের পরিবারেরই থাকেনা! এদের অনেকে ছাত্র ছাত্রী পড়িয়ে নিজের খরচ চালানোর চেষ্টা করে। দুইটি পোশাক দিয়ে তাঁদের কারো কারো বছরেরও বেশি চলে যায়। এতকিছুর পরও এরা কখনো আপনাকে, আমাকে বলবেনা কত কষ্টের মাঝে তাঁদের দিন যাচ্ছে! কারণ এরা জীবনে সম্মানের সাথে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। তাঁদের প্রত্যেককে আমার একেকজন জীবনযোদ্ধা মনে হয়..!
এই ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে, মেয়েগুলো কত শত স্ট্রাগল করে নিজের অহংবোধের একটি জায়গা তৈরি করছে! তাঁরাও মাঝে মাঝে ভেঙে পড়ে জানেন! তখন এই আপনিই হয়ে উঠতে পারেন তাঁর জন্য একটি বড় অনুপ্রেরণা। আপনার প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন, অল্প পরিচিত কিংবা অপরিচিত এই তাঁদের জন্য ছোট্ট করেও একটু ভূমিকা যদি আপনি রাখেন; বিশ্বাস করুন সারাটি জীবন তাঁরা আপনার এই অবদানটুকু মনে রাখার চেষ্টা করবে। নাইবা যদি রাখেও তাতেও খুব কিছু আসে যায় না। আত্মসম্মানবোধ প্রখর হওয়ার কারণে এরা আপনার কাছে কখনোই মুখ খুলে কিছু চাইবে না! কখনো যদি পারেন কাছে ডেকে হাতে “Token of Love” তুলে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, এটা দিয়ে তুমি পছন্দমত কিছু কিনে নিও। অথবা বলতে পারেন আমার ছোট বোনকে একটা উপহার দিয়েছি, তোমাকেও দিচ্ছি নিজের মত কিছু কিনে নিও। এর কিছুই করতে না পারলে মাথায় হাত রেখে এতটুকু কমপক্ষে বলেন, আমি ভাইয়া তোমার পাশে আছি, কখনো প্রয়োজন হলে দ্বিধা ছেড়ে, নিজের বড় ভাই মনে করে আমাকে যেকোনো বিষয় বলো! এই সাহস টুকুও তাদের জন্য বিশাল পাওয়া…
কিছুই না একটু শক্তিই নয়তো হয়ে উঠলেন তাঁর। জানেন তো- এটি একটি চক্রাকার সাইকেলের মত! জীবনকে তখন সেও আপনার মতই দেখার চেষ্টা করবে। হাতে কিছু টাকা দিয়ে ধমকের সুরে সেও হয়তো কাউকে বলে উঠবে- “আমি তোর বড় ভাই এটাকে ‘টৌকেন অব লাভ’ বলে; আর জানিস তো ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে হয়না! ভবিষ্যতে তুই কারো জন্য করলে এই ‘টৌকেন অব লাভ’ এর যথাযথ বিনিময় হয়ে যাবে রে…. ” ক্ষুদ্র এই প্রতীকী ভালবাসা একজন মানুষের জন্য কত বড় শক্তি হয়ে যায় সেটি যদি বুঝতে পারেন, তাহলে আপনার আশপাশে নিজের সাধ্যমত একটু চোখ তুলে তাকাবেন প্লিজ…