নিজস্ব প্রতিবেদক
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দুই কিস্তির ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ একসঙ্গে পেল বাংলাদেশ। চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় এটি তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির অর্থ। মঙ্গলবার (২৪ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে এ অর্থ যোগ হয়েছে। ফলে মোট রিজার্ভ ফের ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানান, মঙ্গলবার দিন শেষে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রোস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, ২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। এর বাহিরে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ এখন প্রায় ১৭ বিলিয়ন।
মোট রিজার্ভ থেকে স্বল্পমেয়াদি দায় বিয়োগ করলে নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের পরিমাণ পাওয়া যায়। তবে এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, তা হলো ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ। এ তথ্য আনুষ্ঠানিক প্রকাশ করে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে আইএমএফের এসডিআর খাতে থাকা ডলার, ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক মুদ্রা ক্লিয়ারিং হিসাবে থাকা বৈদেশিক মুদ্রা এবং আকুর বিল বাদ দিয়ে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভের হিসাব করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের ব্যয়যোগ্য প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৭ বিলিয়ন ডলারে ঘরে আছে। প্রতি মাসে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার হিসেবে এ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়।
চলতি মাসের শুরুতে অর্থাৎ (৪ জুন) পর্যন্ত দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মোট বা গ্রোস রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ০৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিপিএম-৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার আর ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ ছিল ১৬ বিলিয়নের ঘরে।
এর আগে সোমবার বাংলাদেশ সময় রাতে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে আইএমএফ-এর প্রধান কার্যালয়ে সংস্থাটির নির্বাহী পর্ষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণ কর্মসূচির আওতায় তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যালোচনার (রিভিউ) প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয় এবং তা অনুমোদন করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ উঠেছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার (৪৮ বিলিয়ন)। তখন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নজিরবিহীন অর্থপাচার ও বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন (রিজার্ভ)। বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে ক্রমাগত চলতি হিসাবের ঘাটতিও বেড়েছিল বাংলাদেশের। ডলারের বিপরীতে টাকা দর অবনমন হতে থাকলে প্রভাব পড়ে জ্বালানির দর ও আমদানিতে। সংকট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে। ফলে আস্তে আস্তে তলানিতে নামে রিজার্ভ। ওই সময় রিজার্ভ বাড়াতে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সহায়তা নিতে আইএমএফ এর কাছে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা চেয়ে ২০২২ সালের জুলাইতে আবেদন করে বাংলাদেশ।
এরপর ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য সাড়ে ৩ বছর মেয়াদি এই ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করে। ঋণ কর্মসূচি অনুমোদনের সময় আইএমএফ জানিয়েছিল, এই সহায়তা বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, ঝুঁকিতে থাকা ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে।
মূলত চলতি হিসাবে বড় ধরনের ঘাটতি, টাকার অবমূল্যায়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আইএমএফের কাছে এই ঋণ সহায়তা চায়।
মোট ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের মধ্যে বর্ধিত ঋণসহায়তা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সহায়তা (ইএফএফ) বাবদ ৩৩০ কোটি ডলার এবং রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) বাবদ ১৪০ কোটি ডলার অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখযোগ্যভাবে, আরএসএফ আইএমএফের একটি নতুন তহবিল, যেখান থেকে এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথমবারের মতো ঋণ পেয়েছে।
২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬৩ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। একই বছরের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ২০২৪ সালের জুনে তৃতীয় কিস্তির ১১৫ কোটি ডলার বাংলাদেশ পেয়েছে। অর্থাৎ তিন কিস্তিতে আইএমএফ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৩১ কোটি ডলার। বাকি আছে ঋণের ২৩৯ কোটি ডলার। দুই কিস্তির প্রস্তাব অনুমোদিত হওয়ার পর বাকি থাকবে ১২৯ কোটি ডলার, যা পাওয়া যাবে আরও দুই কিস্তিতে।
এদিকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ১৪ বিলিয়নের ডলারের নিচে নামে। সে সময় বৈদেশিক ঋণ ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছ থেকে ডলার কেনার মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়ানো হয়। আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন গভর্নর এসে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ রেখেছে। আবার বিভিন্ন সোর্স থেকে ডলার যোগানের চেষ্টা করছে। ফলে আস্তে আস্তে আবার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে।