নিজস্ব প্রতিবেদক
মিয়ানমারে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। মূলত আরাকান আর্মিকে মোকাবিলা করার জন্য রোহিঙ্গাদেরকে নিয়োগ দিচ্ছে দেশটির জান্তা সরকার। এজন্য জাতিগত নিধনের শিকার রোহিঙ্গাদের দেওয়া হচ্ছে অস্ত্র ও ট্রেনিং।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরাকান আর্মিকে ঠেকানোর জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গাদের নিয়োগ করেছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মিয়ানমার বাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে জাতিগত রাখাইনদের ওপর হামলা করেছে। এর ফলে আরাকান আর্মিও রোহিঙ্গাদের ওপর পাল্টা হামলা চালায়।
এ অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে— যাদের হাতে নির্যাতন-হত্যার শিকার রোহিঙ্গারা এখন সেই জান্তার হয়েই যুদ্ধে নামছে রোহিঙ্গারা, কিন্তু কেন?
এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম বলেন, হতে পারে বাধ্য হয়ে। অথবা, কোনও প্রলোভনে। কিন্তু যে কারণেই হোক, ওখানকার রোহিঙ্গারা আরাকান আর্মির ওপর চড়াও হয়েছে।
তবে এই অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশের জন্য সেটি সমস্যা হতে পারে বলে মনে করেন এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, মিয়ানমারে এখন যে ধরনের সংঘর্ষ চলছে এবং মিয়ানমার আর্মি যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে যে এটি একটি স্মার্ট মুভ হবে। মিয়ানমার আর্মি আরাকান আর্মিকে মোকাবিলা করার জন্য রোহিঙ্গাদের নিয়োগ দিয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের কিছু অস্ত্র ও অল্প সময় ট্রেনিং দিয়ে নামিয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম আশঙ্কা করছেন, ওই দিকের রোহিঙ্গাদেরকে নিয়ে মিয়ানমার আর্মি যদি আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘাতটা বাঁধাতে পারে, তাহলে তার প্রভাব আমাদের এখানকার রোহিঙ্গাদের ওপরও পড়বে। কারণ, তারা দেখবে যে তাদের আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী মারামারিতে লিপ্ত হয়ে গেছে। তখন তারা ভাববে যে রোহিঙ্গাদের মারছে। আর, রোহিঙ্গারা সফল হলে তারাও সেখানে যোগ দিতে চাইবে।
এদিকে কয়েকদিন বিরতির পর ফের গোলাগুলি শুরু হয়েছে টেকনাফের ওপারে। বৃহস্পতিবার রাতভর একের পর এক বিস্ফোরণের বিকট শব্দে স্থানীয়দের মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
স্থানীয়রা বলছেন, দিনের বেলায় সবকিছু মোটামুটি শান্ত থাকলেও গত এক সপ্তাহের বেশি সময় যাবৎ সীমান্তের ওপার থেকে প্রতিরাতে বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে গতকালের (বৃহস্পতিবার) বিস্ফোরণ সবচেয়ে ভীতিকর ছিল।
বিবিসি বার্মিজ সার্ভিস জানিয়েছে, বাংলাদেশ সীমান্তে এখন বড় ধরনের কোনো সংঘাত চলছে না। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এখন সীমান্তে নেই বলে তিনি জানান। তাছাড়া মিয়ানমার নৌবাহিনীর কোনো জাহাজও এখন সীমান্তে নেই।
তবে টেকনাফ সীমান্তের কাছে মংডু টাউনশিপে মিয়ানমার বাহিনী কিছু বিমান হামলা চালিয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। আরাকান আর্মি যাতে সে এলাকা দখল করার জন্য অগ্রসর হতে না পারে সেজন্য এসব বিমান হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিসি বার্মিজ সার্ভিস।
টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে দুই পক্ষের মাঝে ক্রমাগত ঝামেলা চললেও এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের ভেতরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।
বাংলাদেশ থেকে পাচার হচ্ছে রোহিঙ্গা শিশুরা, ব্যবহার করা হচ্ছে যুদ্ধে
চলতি বছরের সর্বশেষ তিন মাসে কক্সবাজারের উখিয়ার নয়াপাড়া ও কুতুপালং এলাকার কয়েকটি ক্যাম্প থেকে ৩২ শিশুকে অপহরণ করা হয়েছে। যাদের বয়স ১৪ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। অভিযোগ রয়েছে, এসব রোহিঙ্গাদের অপহরণের পর পাচার করা হচ্ছে রাখাইনে। সেখানে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে জান্তা সরকার।
এ ছাড়া, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে শিশু, কিশোর-বালকদের ভয় দেখানো, কারসাজি ও প্রলুব্ধ করে সশস্ত্র গ্রুপে যোগ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এজন্য মাসিক ১৫ হাজার টাকা অথবা দৈনিক ৮০০ টাকা রোজগারের প্রলোভন দেওয়া হচ্ছে।
অপহরণের চার মাস পর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা এক শিশুর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের।
সে নিজের ছবি ও নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টের কাছে তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে। কুতুপালং এলাকার একটি ক্যাম্পে বসবাসকারী ওই শিশু চলতি বছর প্রলোভনে পড়ে প্রথমে অপহরণ এবং পরে পাচারের শিকার হয়। তাকে পাচার করে মিয়ানমারে পাঠানো হয়। সেখানে জান্তা সরকারের পক্ষে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় ওই শিশুকে।
১৬ বছর বয়সী ওই শিশু [জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, শূন্য থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু] বলে, ২০১৭ সালে আট বছর বয়সে এখানে আসি। আসার আগে মিয়ানমারে চাচা ও দাদাকে চোখের সামনে মরতে দেখেছি। এখানে আসার পর নির্যাতনের বিষয়টি তাই স্বাভাবিক মনে হতো। মানিয়েও নিয়েছিলাম। আমি স্কুলেও যাওয়া শুরু করেছিলাম। তিন বছর আগে বাবার মৃত্যুর পর আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের বাকি সদস্যদের চিন্তায় নিজেকে কাজে জড়িয়ে ফেলি। কখনও গ্যাস সিলিন্ডার দোকানে দোকানে পৌঁছে দিতাম। কখনও দোকানে কাজ করতাম। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে মাসিক বেতনের প্রতিশ্রুতিতে আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যায় একটা দালাল চক্র। তারা জোরপূর্বক আমাকে মিয়ানমারে নিয়ে যায়। বুঝতে পারি আমাকে অপহরণ করা হয়েছে। কয়েকদিন ট্রেনিংয়ের পর আমাকে রাখাইনে পাঠানো হয়। সেখানে মৃত্যু আর জখম মানুষের কান্নায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
‘ভাবিনি বেঁচে ফিরতে পারব। তবে, কল্পনাতীত হলেও সেটাই হয়েছে। কোনো রকমে জানে বেঁচে পালিয়ে ফের এখানে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না, সবকিছু অনিশ্চিত! পালিয়ে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে। ওরা (সশস্ত্র গ্রুপের সদস্যরা) মাকে হুমকি দিয়েছে, ছোট ভাইকে নির্যাতন করে বলেছে, আমাকে আবার ফিরতে হবে। তা না হলে জানে মেরে ফেলবে। ভয়ে মোবাইল ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছি, পরিবারকে অন্য ক্যাম্পে সরিয়ে নিয়েছি। নিজে রাতে থাকি আরেকটি ক্যাম্পে। অনিশ্চিত জীবন। জানি না কতক্ষণ….।’