করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে দেশের সীমান্তবর্তী, উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় লকডাউন জারি করে স্থানীয় প্রশাসন। আংশিক এলাকায় জারি করা এসব লকডাউনে সংক্রমণ কমেনি, কোথাও কোথাও বেড়েছে। অবশ্য দু–এক জায়গায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি দেখা গেছে। লকডাউন বাস্তবায়নে নজরদারির অভাবেই এমনটি হয়েছে। সঙ্গে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতাকেও দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকেরা। তাই ওই সব এলাকায় শনাক্ত ও মৃত্যুর হার কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমেনি। অনেকে ঢিলেঢালা এসব লকডাউনের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
রাজশাহী, দিনাজপুর, নাটোর ও সাতক্ষীরায় ঢিলেঢালা লকডাউনে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি; বরং লকডাউন–পরবর্তী সংক্রমণ, আক্রান্তের হার ও মৃত্যু বেড়েছে। নড়াইলে অবশ্য সাত দিনের লকডাউন কিছুটা কাজে এসেছে। সংক্রমণ আগের তুলনায় কমেছে খানিকটা। নোয়াখালীতে লকডাউনের পর সংক্রমণের হার কমলেও মৃত্যু কমেনি, তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জে মৃত্যুহার তুলনামূলক কমেছে।
করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, শনাক্ত না করে রোগী রেখে দিলে সংক্রমণ বাড়তেই থাকবে। যে পরিবারে কারও করোনা শনাক্ত হচ্ছে, ওই পরিবারের বাকিদের পরীক্ষা করা হচ্ছে না। লকডাউনে শুধু যানবাহন বন্ধ রাখা হচ্ছে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো উপেক্ষিত থাকছে। ফলে লকডাউন ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
সাতক্ষীরায় ৫ জুন থেকে লকডাউন চলছে, কিন্তু করোনার সংক্রমণ কমছে না; বরং লকডাউন শুরুর আগের চেয়ে সংক্রমণের হার বেড়েছে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে করোনা সংক্রমণের গড় হার ছিল ৪১ শতাংশ। লকডাউন চলাকালে ১৩-১৯ জুন পর্যন্ত সংক্রমণের হার গড়ে ৫২ দশমিক ৪৫ শতাংশ ছিল।
এদিকে লকডাউন দেওয়ার আগে ৩ জুন পর্যন্ত জেলায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৪৭ জন ও করোনা উপসর্গ নিয়ে ২২২ জনের মৃত্যু হয়। সেখানে ১৭ দিনের ব্যবধানে ১৯ জুন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু দাঁড়ায় ৬০ জনে; আর উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু দাঁড়ায় ২৭০ জনে।
শহরের সুলতানপুর এলাকার বাসিন্দা কাজী আনিছুজ্জামান বলেন, লকডাউন সাতক্ষীরায় কঠোরভাবে মানা হচ্ছে না। চলছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। বিশেষ করে সাতক্ষীরা শহরের নিউমার্কেটের পাশ থেকে প্রতিদিন একাধিক মাইক্রোবাস ভর্তি করে যাত্রী নিয়ে যাওয়া হয় শ্যামনগরে।
সাতক্ষীরার সিভিল সার্জন হুসাইন সাফায়াত বললেন, লকডাউন মেনে মানুষ ঘরে না থাকলে করোনার সংক্রমণ কমানো কঠিন। জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, লকডাউনে মানুষ যাতে ঘর থেকে বের না হয়, সে জন্য প্রতিদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
দিনাজপুর জেলা করোনা প্রতিরোধ কমিটি ১৫ থেকে ২১ জুন রাত পর্যন্ত এক সপ্তাহের লকডাউন দিয়েছিল। এই এক সপ্তাহেও করোনার সংক্রমণ স্বাভাবিক না হওয়ায় দিনাজপুরে আরও এক সপ্তাহের লকডাউন দেওয়া হয়েছে।
প্রথম লকডাউন ঘোষণার আগের সপ্তাহে জেলায় ১ হাজার ৩৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয় ৩২০ জনের। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৩১ দশমিক ৮৫। প্রথম দফা লকডাউন শেষ হয়েছে গতকাল সোমবার। লকডাউন চলা অবস্থায় জেলার করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৫ থেকে ২১ জুন পর্যন্ত জেলায় ১ হাজার ৭৯৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছে ৭২৫ জনের। শতকরা হিসাবে ৪০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। জেলা সিভিল সার্জন আব্দুল কুদ্দুস বললেন, যে এক সপ্তাহের লকডাউন পালন করা হলো, তার সুফল পেতে আরও সময় লাগবে।
রাজশাহীতে লকডাউন ঢিলেঢালাভাবে চলছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় ১১ জুন বিকেল থেকে লকডাউন শুরু হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রথম সাত দিনের লকডাউন শেষ হয়। নগরের পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় লকডাউন আরও সাত দিন বাড়ানো হয়। নগরে গতকাল ছিল লকডাউনের ১১তম দিন। লকডাউনের দশম দিনেও রাজশাহী নগরের করোনা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি।
রাজশাহী সিভিল সার্জন দপ্তরের পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৫০১ জনের নমুনা পরীক্ষায় ৩৭৭ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা অনুপাতে শনাক্তের হার ২৫ দশমিক ১২ শতাংশ। আর লকডাউনের শুরুর দিন ১১ জুন জেলায় ১ হাজার ৬৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয় ৩৩৯ জনের। পরীক্ষা অনুপাতে সেদিন শনাক্তের হার ছিল ২০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। সেদিন শুধু নগরে রোগী শনাক্ত হয়েছিল ২৮৬ জন। নগরের বোয়ালিয়া মডেল থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মন বলেন, পুলিশকে লকডাউন বাস্তবায়নের পাশাপাশি অপরাধী ধরাসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। তখন কিছু এলাকায় পুলিশ না গেলে ওই এলাকার মানুষ বেরিয়ে আসে।
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলায় ২ জুন থেকে সাতটি গ্রাম ও ৬ জুন আরও নয়টি গ্রামে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৫ জুন থেকে পুরো উপজেলায় টানা ১৪ দিনব্যাপী লকডাউন চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত রোববার সকাল থেকে চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকা ও আলোকদিয়া ইউনিয়নে লকডাউন শুরু হয়েছে। দামুড়হুদা উপজেলায় লকডাউনের পর সেখানে শনাক্তের হার কমলেও মৃত্যুর দিক দিয়ে এখনো এগিয়ে এই উপজেলা। সর্বশেষ পাঁচ দিনের হিসাবে জেলায় যে ১১ জন মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে ছয়জনের বাড়িই দামুড়হুদায়।
নাটোর ও সিংড়া পৌরসভায় ৯ জুন থেকে শুরু হয় লকডাউন। এর আগে ৮ জুন জেলায় ৬৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪২ জনের সংক্রমণ পাওয়া যায়। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ছিল ৬২ দশমিক ৬। আর গত ২৪ ঘণ্টায় ১২৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ৭৭ জনের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। সংক্রমণের হার ৬২ শতাংশ। জেলা প্রশাসক মো. শাহরিয়াজ জানান, সবাই সম্মিলিতভাবে করোনা মোকাবিলায় অংশ না নিলে এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।
নোয়াখালীতে টানা তৃতীয় সপ্তাহের লকডাউনেও করোনার সংক্রমণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কমেনি। নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার কমলেও বেড়েছে মৃত্যুর হার। ৫ জুন থেকে লকডাউন শুরু হওয়ার আগে সংক্রমণের হার ছিল ৩২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। গত রোববার লকডাউনের ১৬তম দিনে সংক্রমণের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৪২ শতাংশ; আর মৃত্যু ১ দশমিক ২৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ১ দশমিক ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে টানা লকডাউনের ফলে জেলা শহরের সব শ্রেণির ব্যবসায়ীদের দুর্দিন চলছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, দ্রুত লকডাউন শিথিল করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাঁদের ব্যবসার সুযোগ দেওয়া হোক। তবে জেলা করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কমিটির সদস্যসচিব ও জেলা সিভিল সার্জন মাসুম ইফতেখার প্রথম আলোকে বলেছেন, গত ১৬ দিনে পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগ সংক্রমণ শনাক্তের হার ২০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে কাজ করছে।
তবে দুই সপ্তাহের লকডাউনের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণ কমেছে। সিভিল সার্জন জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানিয়েছেন, ২৫ মে থেকে ৭ জুন পর্যন্ত চাঁপাইনবাবগঞ্জ বিশেষ লকডাউনের আওতায় ছিল। লকডাউন শুরুর আগের দিন ২৪ মে জেলায় শনাক্তের হার ছিল ৫৯। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা শনাক্তের হার ২২ দশমিক ১৮।
নড়াইলেও সাত দিনের লকডাউন কিছুটা কাজে এসেছে। লকডাউনের সাত দিনের মাথায় সংক্রমণ আগের তুলনায় কম দেখা গেছে। ১২ জুন সন্ধ্যা থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন শুরু হয় এ জেলায়। শহরের তিনটি আবাসিক এলাকায় ও সদরের একটি ইউনিয়নে এবং লোহাগড়া বাজার এলাকায় প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরদিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত ওই লকডাউন কার্যকর ছিল।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৩ জুন জেলায় ৬৭ জনের নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া যায়। এতে শনাক্ত হন ৩৪ জন। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৫০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ওই দিন করোনায় আক্রান্ত একজন মারা যান, আর ১৯ জুন লকডাউনের শেষ দিনে নমুনা পরীক্ষা হয় ১৫২ জনের, শনাক্ত হন ১৮ জন। শনাক্তের হার ১১ দশমিক ৮৪ শতাংশ এবং একজন মারা যান। তার আগে অর্থাৎ লকডাউনের ষষ্ঠ দিনে আক্রান্তের হার ছিল ৩৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
লোহাগড়া রামনারায়ণ পাবলিক লাইব্রেরির সাবেক সম্পাদক সৈয়দ আকরাম আলী বলেন, ‘লকডাউন অন্তত টানা ১৫ দিন কারফিউর মতো হতে হবে। চোর-পুলিশ খেলার মতো লকডাউনের কোনো কার্যকারিতা নেই।’