নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো সন্ধান মেলেনি তালতলীর নিখোঁজ রেখা বেগম ও নাতি জুনায়েতের। এছাড়া সন্ধান মেলেনি পাথরঘাটার গার্মেন্টকর্মী ফজিলা আক্তার পপিরও। নিখোঁজদের জীবিত থাকার আশা ছেড়ে দিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে তাদের পরিবার। বাড়িতে বাড়িতে চলছে মাতম।
তালতলী উপজেলার জাকিরতবক গ্রামের জাহাঙ্গীর সিকদার ঢাকায় ভ্যান চালিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর স্ত্রী সোনিয়া বেগম দুই পুত্রসন্তান জুনায়েত (৭) ও জোবায়ের এবং মা রেখা বেগমকে (৬০) নিয়ে ঢাকায় স্বামী জাহাঙ্গীরের কাছে যান। ২৩ ডিসেম্বর মা ও সন্তানদের নিয়ে বাড়ি ফিরতে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে ওঠেন সোনিয়া।
রাতে লঞ্চে আগুন লাগলে প্রচণ্ড ধোঁয়া ও আগুনের তীব্রতায় মা রেখা বেগম ও বড় ছেলে জুনায়েত হারিয়ে যায়। জীবন বাঁচাতে এক বছরের শিশুপুত্র জোবায়েরকে কোলে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন সোনিয়া। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে ঝালকাঠি হাসপাতালে ভর্তি করেন। কিন্তু মা রেখা বেগম ও বড় ছেলে জুনায়েত নিখোঁজ হন।
স্বজনরা তাদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রশাসনের উদ্ধার করা লাশের মধ্যেও খুঁজে পাননি। নিখোঁজের ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তাদের কোনো সন্ধান মেলেনি। মা ও পুত্রসন্তানকে হারিয়ে সোনিয়া বেগম এখন পাগলপ্রায়। তিনি তার পুত্রসন্তান এবং মাকে ফিরে পেতে চান। অপরদিকে মাকে হারিয়ে মাদরাসা পড়ুয়া শিশুকন্যা সুমি বেগম মূর্ছা যাচ্ছে। সে তার মায়ের লাশটা ফেরত চায়।
কথা হয় বেঁচে ফেরা যাত্রী সোনিয়া আক্তারের সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমি আমার বুকের ধন জুনায়েতকে ফিরে পেতে চাই। আমার কিছুই লাগবে না শুধু আমার ছেলে ও মাকে চাই। রেখা বেগমের ছোট মেয়ে সুমি বেগম বলেন, মা তো বেঁচেই নেই কিন্তু মায়ের লাশটা চাই। লাশটা পেলেও কবর দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম।
জুনায়েতের বাবা ও রেখা বেগমের জামাতা জাহাঙ্গীর সিকদার বলেন, লঞ্চ, হাসপাতাল, নদী ও প্রশাসনের উদ্ধার করা লাশের মধ্যে খুঁজেও কোথাও আমার ছেলে ও শাশুড়িকে পাইনি। লাশ দুটি পেলেও নিশ্চিত হতে পারতাম যে তারা মারা গেছে।
পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের ছোট টেংরা গ্রামের আফজাল হোসেনের মেয়ে ফজিলা আক্তার পপি (২৬)। ৭ বছর আগে স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ হয় তার। একমাত্র মেয়ে লামিয়ার (১১) লেখাপড়া ও জীবিকার তাগিদে ঢাকার একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেন পপি।
২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে বরগুনার উদ্দেশ্য রওনা হন তিনি। নিজ কর্মস্থল ঢাকার সাভারে বিদ্যালয়ে মেয়েকে ভর্তি করানোর স্বপ্ন বুনে বাবার বাড়ি থেকে মেয়েকে নিতে আসছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! পপির ইচ্ছেটা পূরণ হলো না। দুর্ঘটনার পর স্বজনরা তাকে লঞ্চে, নদী, বিভিন্ন হাসপাতাল ও প্রশাসনের উদ্ধার করা লাশের মধ্যেও খুঁজে পাননি।
কথা হয় পপির বৃদ্ধ বাবা আফজাল হোসেনের সঙ্গে। কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে কীভাবে থাকব? জামাই মেয়েটাকে ৭ বছর আগে তালাক দেয়। জীবনের তাগিদে তাই ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করতো সে। মেয়ের লাশটা পেলেও কবরটা দেখতে পেতাম।
পপির মেয়ে লামিয়া বলে, ‘মা বলছিল বাড়িতে এসে আমাকে ঢাকায় নিয়ে ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করে দেবে। এখনো মা আসেনি। শুনেছি যে লঞ্চে আগুন লেগেছে সেই লঞ্চেই আমার মা আসতেছিল। এখন আমায় মা বলে কে ডাকবে? মা কি আসবে?
বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত ৪৫ জনের মরদেহ গ্রহণ করেছে বরগুনা জেলা প্রশাসন। এরমধ্যে ২৩ জনের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় তাদের গণকবরে দাফন করা হয়েছে। বাকিদের শনাক্ত করে তাদের স্বজনরা নিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত নিহতদের পরিবারকে দাফন কাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে সহায়তা করা হয়েছে। পরিচয় শনাক্তের জন্য এখন পর্যন্ত ৪৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বাকি আরও দুজনের নমুনা সংগ্রহ করা হবে।
প্রসঙ্গত, ২৩ ডিসেম্বর রাত ৩টার দিকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদী অতিক্রমকালে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৪৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২৩ জনের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় তাদের বরগুনা সদরের পোটকাখালী গ্রামে খাকদোন নদীর তীরবর্তী গণকবরে দাফন করা হয়েছে। এ ঘটনায় বরগুনা, ঝালকাঠি ও ঢাকায় তিনটি মামলা হয়েছে। মামলায় লঞ্চের মালিকসহ পাঁচজন কারাগারে রয়েছেন।
বিএসডি/ এলএল