উন্নত জীবনের আশায় প্রত্যেক বছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার অভিবাসী ইউরোপে পাড়ি জমান। যদিও পাচারকারীদের প্রলোভনে অনেকের উন্নত জীবনের স্বপ্নের সলিল সমাধি ঘটে ইউরোপের কণ্টকাকীর্ণ ভূমধ্যসাগরীয় জলপথে। তবে ভাগ্যের জোরে যারা পৌঁছে যান ইউরোপে, তাদের অনেকেই বাঁধা পড়েন দাসত্বের শেকলে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এমন বাংলাদেশি অভিবাসীদের ইউরোপে গিয়ে দাসত্বের বেড়াজালে আটকা পড়ার কাহিনী তুলে ধরেছে এক প্রতিবেদনে।
ইতালির পালেরমো শহরের এক এলাকায় চেয়ারে অস্বস্তি নিয়ে বসে মোবাইল নাড়াচড়া করছেন বাংলাদেশি এক তরুণ অভিবাসী। তার নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে ছদ্মনাম ‘আলী’ ধরে তার লিবিয়াতে পৌঁছানোর কাহিনীর শুনেছে বিবিসি।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে আলীর বয়স ছিল ১৯ বছর। বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে ওই বছর কাজের সন্ধানে ঝুঁকিপূর্ণ ইউরোপ যাত্রার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এক দালালের সাথে পরিচয় হয় তার। সেই দালালই প্রতিনিয়ত তাকে ইউরোপে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখান। এই দালালরা তরুণদের টার্গেট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাচার শিকার করেন।
দালালদের সহায়তায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে কীভাবে বাংলাদেশ থেকে ইতালির সিসিলি দ্বীপে পৌঁছেছেন, সেই কাহিনীর বিশদ বলেছেন আরেক বাংলাদেশি। সেই সময় দালালরা তার বয়স বাড়িয়ে ২১ করে নথিপত্র তৈরি করেন। তিনি বলেন, আমার পরিবার চেয়েছিল আমি বিদেশে যাই। কিন্তু বয়স কম হওয়ায় সেটি সম্ভব হতো না। পরে পরিবারের সদস্যরা দালালকে অর্থ দিয়ে একটি ভুয়া পাসপোর্ট বানানোর সিদ্ধান্ত নেন।
এই দালালের সঙ্গে আলীর বন্ধুত্ব হয়। তিনি সব সময় তাকে লিবিয়ায় পাড়ি জমানোর উৎসাহ দিতে থাকেন। এমনকি প্রায় প্রত্যেকদিন নিজের বাড়িতে আলীকে ডেকে রাতে খাবার খাওয়ান।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে একটি কসমেটিকসের দোকানে কয়েক বছর ধরে কাজ করেছেন আলী। দোকানে কাজ করে ঢাকার বাইরে পদ্মা নদীর ধারে গ্রামে বসবাসরত পরিবারকে সহায়তার চেষ্টা করতেন তিনি।
আলীর মতো যেসব তরুণ দারিদ্র থেকে পালিয়ে বাঁচতে চান এবং সুযোগের অভাবে সেটি হয় না, সেই তরুণদের আশাকে পুঁজি করেন দালালরা। কিন্তু দালালদের হাত ধরে যারা দেশ ছেড়েছেন তাদের খুব কম সংখ্যকই জানেন যে, নৃশংস গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি দেশ লিবিয়া। এই দেশটিতে যারা পাচারের শিকার হয়েছেন তাদের বাস্তবতা হলো, দুর্বিষহ জীবন, শোষণ এবং দাসত্ব।
‘লিবিয়া সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না,’ স্বীকার করেন আলী।
ওই দালাল আলীর বাবা-মায়ের সাথে বৈঠক করেন। তাদের বলেন, ‘লিবিয়ায় কারখানায় কাজ করে তাদের ছেলে মাসে ৫০০ ডলার (বাংলাদেশি ৪২ হাজার ৬ টাকার বেশি) আয় করতে পারবেন।’
আলীর বাবা-মা বলেন, ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর মতো কোনো অর্থ তাদের নেই। তাদের কী সম্পদ আছে সেটি খুঁজে দেখার পর দালাল তিনটি বড় গরু পান। সেখান থেকে একটি বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে উৎসাহ দেন দালাল।
মুক্তিপণের জন্য বন্দি
ঢাকা থেকে বাস যোগে ভারতের কলকাতা। সেখান থেকে বিভিন্ন ফ্লাইটে মুম্বাই, দুবাই হয়ে কায়রো। তারপর লিবিয়া। আলীর এই লিবিয়া যাত্রায় সময় লেগেছে প্রায় এক সপ্তাহ। বেনগাজি বিমানবন্দরে অবতরণের পর তিনি বিশৃঙ্খল এক শহর দেখতে পান; যেখানে পুলিশ কিংবা অন্য কোনো নিরাপত্তা বাহিনী নেই।
পরে দ্রুত সেখান থেকে দালালের স্থানীয় এক ব্যক্তি তাকে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে রাখে। এ সময় তার কাছে যত অর্থ ছিল সবকিছু নিয়ে নেন সেই ব্যক্তি। পরে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাকে আটকে রাখা হয়। ছেলেকে মুক্ত করার জন্য দেশে শেষ দু’টি গরু বিক্রি করে দেন বাবা-মা।
ছোট্ট যে কক্ষে তাকে আটকে রাখা হয়, সেখানে কোনো তোষক ছিল না। অন্য ১৫ বাংলাদেশির সঙ্গে ভাগাভাগি করে থাকতে হতো সেই কক্ষে। যারা মুক্তিপণের অর্থ দিতে পারতো না তাদের খাবার জুটতো না এবং মারধর করা হতো।
আলী বলেন, তারা আমার সামনে একজনকে মারধর করে; তার উরু থেকে রক্ত ঝরছিল। তাদের কেউ তাকে সহায়তা করেনি অথবা তাকে হাসপাতালেও নেয়নি।
লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে বন্দি বাংলাদেশিদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি গত কয়েক বছরে আরও বেশি খারাপ হয়েছে। গত বছরের মে মাসে দেশটির রাজধানী ত্রিপোলির কাছের মিজদাহ এলাকায় একটি গুদামে ৩০ জনকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়; যাদের ২৬ জনই বাংলাদেশি।
সেদিন বেঁচে যাওয়া একজন বলেন, যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের পরিবার মুক্তিপণ পরিশোধ করতে পারছিল না।
বিনা পারিশ্রমিকে কাজ
অবশেষে আলী যখন মুক্তি পান, তখন তাকে বেনগাজিতে পাচারকারীদের একটি পানির বোতল প্রক্রিয়াজাত কারখানায় বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হয়। এর পর সেখান থেকে ত্রিপোলিতে গিয়ে একটি টাইল কারখানায় কাজ করেন তিনি।
লিবিয়ায় বর্তমানে আলীর মতো আরও ২০ হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী রয়েছেন; যাদের পারিশ্রমিক ছাড়াই কাজ করতে হয়। তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়। অসহনীয় পরিস্থিতিতে কাজ করেন তারা।
আলী বলেন, কাজ বন্ধ করে দিলেই আমাদের মারধর করা হতো। লাথি মেরে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হতো। একবার আমাদের মধ্যে একজন একটি টাইল ভেঙে ফেলে। পরে এক ব্যক্তি এসে তাকে লাথি মারেন। ওই কিশোর টাইল কারখানার মালিকের একটি কক্ষে বসবাস করতো, যাকে কাজ শেষে সেই কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হতো।
‘মালিক আমাদের কাজের জন্য নিয়ে যেতেন, যখন কাজ শেষ হতো, তখন আমাদের বাসায় নিয়ে আসতেন তিনি। দু’জন নিরাপত্তারক্ষী আমাদের নজরদারি করতেন। কাজের জন্য আমাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না। পর্যাপ্ত খাবার ছিল না। যে কারণে আমরা পালাতে চেয়েছিলাম।’
‘আমাদের একজন পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি দ্বিতীয় তলা থেকে পড়ে যান এবং তার পা ভেঙে যায়।’
বেশ কয়েকবার পলায়নের ব্যর্থ চেষ্টার পর লিবিয়ার এক ব্যক্তির সহায়তায় আলী একটি মসজিদে আশ্রয় পান। এবার ইতালির উদ্দেশ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার জন্য আবারও পাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করাই ছিল তার একমাত্র বিকল্প উপায়।
সাগরে হাঙর
তার বাবা-মা আবার অর্থ পাঠিয়ে দেন। বাংলাদেশ থেকে শেষ পর্যন্ত ইতালি পৌঁছাতে আলীর মোট ৪ হাজার ডলার (বাংলাদেশি ৩ লাখ ৪১ হাজার টাকার বেশি) ব্যয় হয়। যা তার পরিবারকে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ফাঁদে ফেলে। গত বছরের জুলাইয়ে ডিঙি নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন আলী ও তার সঙ্গী অন্য ৭৯ অভিবাসী।
‘পুরো দু’দিন আমরা শুধু সাগর দেখেছি, কোনো কূল-কিনারা নেই। নিকট দূরত্বে আমরা দু’টি হাঙর দেখতে পাই। এক পর্যায়ে তাদের কেউ একজন বলেন, হাঙর আমাদের খেতে আসছে। ভাবলাম, আমরা শেষ।’
শেষ পর্যন্ত তাদের উদ্ধার করে ইতালির ল্যাম্পেদুসা দ্বীপে নেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে সিসিলি। আলী বর্তমানে সিসিলির রাজধানী পালেরমোর উপকণ্ঠের বিশাল এক অভিবাসী শিবিরে বসবাস করেন। এই শিবিরে নাইজেরিয়া, গাম্বিয়া এবং সেনেগাল থেকে আসা অভিবাসীরা বসবাস করছেন।
তিনি বলেন, লিবিয়ায় পাচারকারীদের বন্দিশালায় বাংলাদেশি অন্য দেশের কারও সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। সেখানে বিভিন্ন দেশের লোকজনকে আলাদা আলাদা রাখা হয়।
সুশির স্বপ্ন
আলী ইতালিতে কাজের অস্থায়ী নথি পেয়েছেন, যা তাকে সেখানে কাজের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু তার মানবিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এটার বিরুদ্ধে তিনি আপিল করছেন।
এখন তিনি পালেরমোর নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছেন। বর্তমানে আফ্রিকা থেকে আসা অভিবাসীদের সঙ্গে একটি সুশি রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন আলী।
সম্প্রতি সেখানে আসা অন্যান্য অভিবাসীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চলতে হচ্ছে আলীকে। একজন সিসিলিয়ান মাসে প্রায় ৮৭০ ডলার পারিশ্রমিক পান। সেই তুলনায় আলীর পারিশ্রমিক অনেক কম। তিনি সেই আয় থেকে ৫৭০ ডলার আবার দেশেও পাঠান।
গত কয়েক বছরে পালেরমোতে সুশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্ত এই শহরে মাত্র অল্প কিছু জাপানি নাগরিকের বসবাস। তবে সম্প্রতি চীনা রেস্তোরাঁও সেখানে গড়ে উঠতে দেখা গেছে।
পালেরমোতে পৌঁছানোর আগে কখনোই সুশির নাম শোনেননি আলী। ধীরে ধীরে কাঁচা চিংড়ির স্বাদ উপভোগ করতে শুরু করেছেন তিনি। এটি তার স্বপ্নেও প্রভাব ফেলছে।
আলী বলেন, ‘সুশি কীভাবে বানাতে হয়, তা আমি পুরোপুরি শিখতে চাই। ইতালীয় ভাষাও শিখতে চাই।’
সূত্র: বিবিসি
বিএসডি/ এলএল