বছরের শুরুতেই বিশ্বব্যাপী মানুষ জন নতুন এক শব্দের সাথে পরিচিত হয়েছেন; তা হলো করোনাভাইরাস। যা পুরো বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। শিশুরা প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত হলেও বলা যেতে পারে অধিকাংশ শিশুরা এই করোনাভাইরাসের নিরব শিকার।
পরিবারের অর্থনৈতিক ও অভুক্ত শিশু:
“জীবন কারো জন্য বিলাসিতা
আবার কারো জন্য যুদ্ধ ”
এমনই এক বাস্তব কথা তুলে ধরছি:
রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিক্টোরিয়া পার্কে বসে ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো মায়াভরা প্রথম শ্রেণির ছোট্ট ছেলে নাহিদ। আমাকে এসে বলছে “ভাইয়া কয়ডা ট্যাহা দেন সকাল থেকে কিছু খাই নাই” অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি! এতটুকু ছেলে কতই বা বয়স হবে ৯ থেকে ১০ বছর। এই বয়সে ছেলেটির হাসিমুখে খেলার সাথী ও সহপাঠীদের সাথে স্কুলে যাওয়ার কথা। আর সন্ধ্যা হলে বসতবাড়িতে পড়তে বসা। কিন্তু ছেলেটি তা না করে মানুষের কাছে হাত পাতছে। শুধুমাত্র একবেলা আহারের জন্য।
নাহিদকে জিজ্ঞেস করলে বলে, মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। বাবা রিকশা চালান। আমরা তিন ভাইবোন। তার মধ্যে আমি বড়। বুঝতে পারলাম নাহিদ ও তার বাবা-মায়ের পরিবার অভুক্ত দিন কাটাচ্ছে। আর এমন হওয়ার একমাত্র কারণ এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। নাহিদের বাবা-মায়ের বেকারত্ব ও আয় কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে তাদের পরিবারের উপর। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করছি, বর্তমান শিশু ও তার পরিবার বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে অর্থনৈতিক যে প্রভাব পড়ছে তাতে দরিদ্র ও হতদরিদ্রর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের আয় কমে গেলে ওই উপার্জনক্ষম ব্যক্তির উপর পরিবারের অন্যান্য সদস্য যারা নির্ভরশীল তাদের পুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রভাব পড়ছে।
বিষয়টা এমন যে আগে বাবা-মা তাদের সন্তানকে সপ্তাহে দুধ, ডিম পাঁচদিনই দিতে পারতেন। কিন্তু এখন সপ্তাহে দুধ, ডিম খাওয়াতে পারছেন না। ডিম দিতে পারলেও চারটির পরিবর্তে একটি খাওয়াচ্ছেন। এমন রূপ ইতিমধ্যেই বাস্তবে দিতে শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তাদের একটি জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৪ শতাংশ শিশু জানিয়েছে, তাদের পরিবার কঠিন খাদ্য সংকটে রয়েছে। জরিপটি খুব ছোট পরিসরে করা হলেও এ থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ:
আমি মনে করি স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাদ্য, অপুষ্টি এবং একাকীত্ব ছাড়াও শিশুরা নানাভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা এটাকে বলছেন, সেকেন্ডারি এফেক্ট। দীর্ঘদিন যাবৎ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকার কারণে দারিদ্র্যের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য অনেক শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। বেড়ে যাচ্ছে বাল্যবিবাহ ও শিশু শ্রম।
এক বেলা আহার যোগাতে যুক্ত হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। যেমনটা নাহিদকে দেখা গিয়েছে। ইদানিং শহর বাজারে রাস্তায় এমন অনেক শিশুকেই ভিক্ষা করতে দেখা যায়। আবার অনেক শিশু নিজেই উপার্জন করতে নেমে গিয়েছে। বুড়িগঙ্গা ব্রিজের ওপর গেলেই দেখা মেলে ভ্যানে করে মানুষ পারাপার করছে। তাদের অনেকেরই বয়স নয় দশ বছরের মধ্যে। এরকম অনেক শিশু বিভিন্ন কাজে যুক্ত। যা এসব কাজের জন্য তারা একেবারেই অযোগ্য।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বলছে, ২০০০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমের হার কমেছিল ৯৪ শতাংশ। কিন্তু করোনাভাইরাস মহমারির কারণে দেড় বছরে এর প্রবণতা উল্টো পথে যাওয়া শুরু করেছে। লক্ষ লক্ষ শিশু আবারও শিশুশ্রমে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে বলে সংস্থাটি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
শিশুদের আচরণগত পরিবর্তন এবং বিষণ্নতা:
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস শুরু হওয়ার পর থেকে শিশুরা হতাশায় ভুগছে। নেই স্কুল, নেই বন্ধুদের সাথে দেখা, নেই খেলাধুলা, ঘরের চার দেয়াল ছাড়া কোথাও বেড়াতে যাওয়ার উপায় নেই। আবার অন্যদিকে সারাদিন মৃত্যুর মিছিল, টিভির পর্দা খুললেই দেখা যায় মৃত্যু ও করোনা আক্রান্তের সংখ্যা।
পরিবারের বাবা-মায়ের আয়-রোজগার আর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা নিয়ে উদ্বেগ। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত না হলেও এ থেকে মুক্তির উপায় নেই। শিশুরা করোনাভাইরাস কি বুঝতে না পারলেও বাসা-বাড়িতে এ বিষয়ে কথা বলছেন বড়রা। বাবা-মায়ের সংসার চলবে কি করে, টাকা পয়সা নেই, আয়-রোজগার বন্ধ। কি হবে সামনে? সেসব বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ কথাবার্তা বলছেন। বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তায় শিশুদের বেড়েই চলছে বিষন্নতা। তাদের মধ্যে দেখা দিতে পারে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। সব মিলিয়ে ক্ষুধা, অপুষ্টি নিশ্চিতভাবেই দীর্ঘমেয়াদী একটা ট্রমা রেখে যাবে এই প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস।
লেখা- মো.ইব্রাহীম প্রামানিক। শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।