দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিতে যেন এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সরকার ও বিরোধী—দুই শিবিরেই এ শূন্যতা অনুভূত হচ্ছে। সরকার যেমন যে কোনো বিষয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারছে কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতা ছাড়া। তেমনি জনসম্পৃক্ত কোনো ইস্যুতে সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারছে না দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলো। বিরোধী রাজনীতির এই ‘শূন্য মাঠে’ এখন কেবল দেখা যাচ্ছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে।
শীর্ষ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এসি কক্ষে বা ভার্চুয়াল প্লাটফর্মে সভা-সেমিনারে মুখ দেখালেও রাজপথে দেখা যাচ্ছে শুধু জাফরুল্লাহকেই। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের নেতৃত্বাধীন অধিকার পরিষদ, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলনসহ কয়েকটি বাম সংগঠনকে নিয়ে রাজপথ সরব রাখা জাফরুল্লাহকে নিয়ে তাই রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে রাজনীতিতে এক ধরনের ‘অচলায়তন’ গড়ে উঠেছে। সরকার এককভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। সেখানে সরকারি দল আওয়ামী লীগের সমর্থক বা তাদের জোট ১৪ দলের শরিক কারও কোনো ভূমিকা আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। অন্যদিকে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে বিরোধী দলগুলোও তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। একাধিকবার সরকার গঠন করা শীর্ষস্থানীয় দল বিএনপিও এখন যেন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। ব্যর্থতার গ্লানি বইতে না পেরে বিএনপি এখন তাদের নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে পাশ কাটিয়ে এককভাবে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করছে। ফলে সরকারবিরোধী শিবিরের দুই বড় প্লাটফর্ম ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। যেজন্য রাজপথের আন্দোলনে জোট শরিকদের দেখা যায় না বললেই চলে।
২০ দলীয় জোটের শরিকদের মধ্যে কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদের এলডিপি এবং মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহীমের বাংলাদেশের কল্যাণ পার্টি ছাড়া বেশিরভাগ দলেরই বিবৃতি-বিজ্ঞপ্তি ছাড়া অস্তিত্ব বোঝা দায়। যদিও মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকার কারণে আগে থেকেই কোণঠাসা জামায়াত। অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক গণফোরাম ও জেএসডি দুই-একটা সভা-সেমিনার করলেও মাঠে দেখা মেলে না তাদের। অবশ্য মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য মাঠকেন্দ্রিক কিছু কর্মসূচিতে সরব থাকতে চাইছে। তবে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম সংগঠক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে।
গত ৩ মার্চ হুইল চেয়ারে বসেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন। কারাগারে থাকাবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনার বিচার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে ওই কর্মসূচিতে ছিলেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিশিষ্ট আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ডাকুসর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর, ভাসানী অনুসারী পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বাবলু, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড মহাসচিব কাউন্সিলের নঈম জাহাঙ্গীর, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা চৌধুরী, ডিজিটাল নিরাপত্তা নিরাপত্তা আইনে কারাভোগ করা ‘রাষ্ট্রচিন্তা’র সদস্য দিদারুল আলম ভূঁইয়া, ছাত্র অধিকার পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মুহাম্মাদ রাশেদ খাঁন প্রমুখ।
সম্প্রতি সুনামগঞ্জের শাল্লায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটলে ২৩ মার্চ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যান ৭৯ বছর বয়সী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তারপর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘ভাসানী অনুসারী পরিষদ’ আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশেও যোগ দেন জাফরুল্লাহ।
রাজপথে এভাবে সরব থাকা জাফরুল্লাহ যোগ দিচ্ছেন প্রেসক্লাব বা অন্য কোনো মিলনায়তনকেন্দ্রিক সভা-সেমিনারেও। গত ৩০ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘নৈতিক সমাজ’ নামে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানেও দেখা যায় তাকে। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমাদের জ্ঞানের চোখ বন্ধ হয়ে গেছে; আমরা সত্য জানছি না। অনেক দেশ আমাদের শাসন করেছে। আমরা গাড়ি ভাঙচুর চাই না, উন্মাদনা চাই না, কথা বলার ও আমার বক্তব্য তুলে ধরার অধিকার চাই।’
রাজপথে জাফরুল্লাহর এভাবে সরব থাকার বিষয়ে ‘দেশ বাাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’ নামক সংগঠনের সভাপতি কে এম রকিবুল ইসলাম রিপন বলেন, ‘সরকারের যে বিরাজনীতিকরণ-নীতি, তার ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতার মাঝে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এসব কার্যক্রম জনমনে বেশ সাহস যোগাচ্ছে। এই বয়সে অসুস্থ শরীর নিয়ে তিনি যেভাবে ছুটে বেড়ান তাতে করে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কিছুটা হলেও অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। জনগণ ও দেশের পক্ষে প্রায় প্রতিটি ইস্যুতে তার বক্তব্য পাওয়া যায়। সুযোগ পেলেই তিনি দেশের যে কোনো প্রান্তে ছুটে যান এবং বিষয়ভিত্তিক কথা বলেন। আমরা তো বলি সাহসীদের নিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী দুঃসাহসিক অভিযানে নেমেছেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২০ দলীয় জোটের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘আসলে রাজনৈতিক শূন্যতার কারণে এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ‘একলা চলো’ নীতির কারণে বিরোধী শিবিরে যখন অনেকটা হতাশা বিরাজ করছে, তখন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সাহসিকতার পরিচয় বহন করে। বিএনপি আসলে কী চায় তারা হয়তো নিজেরাই জানে না, অথবা তাদের নিজেদের কাছেই তারা পরিষ্কার নয়। দূর দেশ থেকে যখন দল বা দলের কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তখন সে দল জনগণের আশা কতটুকু পূরণ করতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়।’
ডা. জাফরুল্লাহর এভাবে বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্বভাগে চলে আসা নিয়ে অবশ্য নেতিবাচক আলোচনাও আছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো কোনো নেতা জাফরুল্লাহর এসব কর্মসূচিকে ‘গণতান্ত্রিক চর্চা দেখানোর তৎপরতা’ বলেও অভিহিত করছেন।
তবে ২০ দলীয় জোটের ওই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘ছোট ছোট সংগঠন নিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কর্মসূচি নিয়ে অনেকে নানা মন্তব্য করলেও এটা বুঝতে হবে, তারা কেউ কিন্তু রাজপথে নেই। তারা নিজের আলোয় নয়, বিএনপির আলোতে আলোকিত হতে চায়। বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অতিথি করে এসি রুমে বড় বড় বক্তৃতা দেয়া আর জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মত মাঠে থাকা এক বিষয় নয়। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চলমান কর্মসূচি বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মনে অনুপ্রেরণা যোগায়। রাজনৈতিক স্থবিরতা ও শূন্যতার মাঝে তার এই কর্মকাণ্ড তাৎপর্যপূর্ণ। এসব কার্যক্রম রাজনৈতিক ভারসাম্য আনার আশা যোগায়।’
বড় বড় দল বা জোটকে পাশ কাটিয়ে ছোট ছোট দল-সংগঠন নিয়ে যে তৎপরতা শুরু করেছেন, সে ব্যাপারে জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘লক্ষ্য সুস্পষ্ট, সুষ্ঠু গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা, বৈষম্য হ্রাস করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।’
২০১৮ সালের নির্বাচনকেন্দ্রিক গড়ে ওঠা প্লাটফর্ম জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জনগণের কাছে আবেদন হারিয়েছে, এই কারণেই ছোট দলের সঙ্গে মিলে মাঠে নেমেছেন কি-না, জানতে চাইলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট এখন ফাংশনাল নয়, ওটা নিয়ে কথা বলে লাভ নেই’।