নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাবির চারুকলা অনুষদে পয়লা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা মূল মোটিফ ‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি’ পুড়িয়ে ফেলে দুর্বৃত্ত। শোভাযাত্রার আগেই এ ঘটনায় জড়িতকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের সুখবর দেবে বলেছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। শোভাযাত্রা শেষ হয়েছে আজ দুপুরের আগেই। কিন্তু সন্দিগ্ধ কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
ডিএমপির তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতি’ পোড়ানোর ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। গোয়েন্দা কাজ করছে। তবে চেষ্টা সত্ত্বেও এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
শনিবার (১২ এপ্রিল) ভোর ৪টা থেকে ৫টার মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে নববর্ষের ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ উপলক্ষ্যে বানানো আলোচিত মোটিফ ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিসহ শান্তির পায়রা মোটিফের একাংশও আগুনে পোড়ানো হয়।
গতকাল রোববার দুপুরে নববর্ষের নিরাপত্তা সম্পর্কে ব্রিফিংকালে স্বপ্রণোদিত হয়ে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছিলেন, আমরা কোনো মামলা তদন্তের আগে কোনো কথা বলি না। তবে এই ঘটনায় আমরা অত্যন্ত ক্লোজ। এই মামলার তদন্ত ও জড়িতকে শনাক্তে আমরা খুব নিকটে পৌঁছে গেছি। আমরা আশা করছি সোমবার শোভাযাত্রা শুরুর আগেই একটা সুখবর দিতে পারব। এর মধ্যে আমরা যথাসম্ভব জড়িত দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবো ইনশাল্লাহ।
এছাড়াও এদিন রমনা বটমূলের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এসে র্যাব মহাপরিচালক এ কে এম শহিদুর রহমান বলেছিলেন, যে ঘটনাটি ঘটেছে, তার তদন্ত হবে। ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যারা ছিলেন, তাদের কোনো ঘাটতি ছিল কি না, সেটাও তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। যদি সেরকম কিছু পাওয়া যায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ‘ফ্যাসিস্টের প্রতিকৃতিতে’ আগুন দেওয়ার ঘটনায় সিসিটিভি ভিডিওতে মাস্ক পরা যে যুবককে দেখা গেছে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগ কর্মী বলে ওই বিভাগের শিক্ষার্থীদের ধারণা। কিন্তু আগুন দেওয়ার ঘটনায় দুই দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
উৎসবের আগে এভাবে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ নামে ওই মোটিফে পরিকল্পিতভাবে আগুন দেওয়া হয়েছে বলে সন্দেহ করছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, জড়িত কারো পরিচয় প্রকাশ করে দিলে তাকে আইনের আওতায় আনা কঠিন হয়ে যায়। সিসিটিভি ফুটেজ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে যাওয়ায় জড়িত ওই যুবককে গ্রেপ্তার করা কঠিন হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রেপ্তার সম্ভব হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমরা কনফার্ম করব, আমরা গ্রেপ্তারের সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এখন কাজটা কঠিন হয়ে গেছে। কারণ সন্দেহভাজন ওই যুবক হয়ত সতর্ক হয়ে আত্মগোপন করেছে। তবে অভিযুক্ত যুবক ও মদদদাতাদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন অ্যান্ড গোয়েন্দা-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিবি পুলিশের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ ও ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফ পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের সুখবর সম্পর্কে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে কল রিসিভ করেননি ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
এদিকে আগুন দেওয়ার ওই সিসি ক্যামেরার ভিডিও গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে আরবি বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তারা বলছেন, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ওই যুবক থাকতেন মাস্টারদা সূর্যসেন হলে। নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের অনুসারী হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাকে আর হলে দেখা যায়নি।
আরবি বিভাগের ওই ব্যাচের শিক্ষার্থী শরীফ আহমেদ বলেন, আমরা সবাই তাকে ভিডিও দেখে চিনতে পেরেছি। সে কয়েকদিন আগে বিজয় ৭১ হলের সামনে এসে ছাত্রলীগের স্লোগান দিয়ে গেছে। তার ফেসবুক কমেন্ট ও পোস্ট এখনও মারাত্মক লেভেলের আক্রমণাত্মক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদ বলেন, আমাদেরও মনে হয়েছে ওই ছেলে হয়ে থাকতে পারে। আমরা বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। এখন তদন্ত চলছে।
তবে ভারতে পালানো শেখ হাসিনার দোসররা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। শনিবার (১২ এপ্রিল) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তিনি বলেন, ‘হাসিনার দোসররা ভোর রাতে চারুকলায় ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃসাহস যারা দেখিয়েছে- সফট আওয়ামী লীগ হোক বা আওয়ামী বি টিম হোক- তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আসতে হবে, দ্রুত। এই শোভাযাত্রা থামানোর চেষ্টায় আওয়ামী লীগের হয়ে যারা কাজ করছে, আমরা শুধু তাদের আইনের আওতায় আনব তা না, আমরা নিশ্চিত করতে চাই এবারের শোভাযাত্রা যেন আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়।’
পোস্টে তিনি আরও লেখেন, ‘আমরা এখন আরও বেশি ডিটারমাইন্ড এবং আরও বেশি সংখ্যায় অংশ নেব। গত কিছুদিন জুলাই আন্দোলনের পক্ষের অনেকেই বলেছিলেন, এবারের শোভাযাত্রা সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভিন্ন রকমের হচ্ছে। এখানে ফ্যাসিবাদের ওই বিকট মুখ না রাখাই ভালো। আমরাও সব রকম মত নিয়েই ভাবছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মত জানার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু আজকের ঘটনার পর এই দানবের উপস্থিতি আরও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল।’