নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের গড় আইকিউ (বুদ্ধিমত্তা) স্তর তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার বিষয়টি কেবল একটি পরিসংখ্যানগত তথ্য নয়, বরং এটি দেশের মানবসম্পদের বিকাশ ও সক্ষমতার উন্নয়নের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। মেধার এই ঘাটতি আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। তবে, এই সমস্যার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করা গেলে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া গেলে পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি সম্ভব।
বাংলাদেশে আইকিউ স্তর কম হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো-
১. পুষ্টির অভাব : শৈশব এবং গর্ভাবস্থার সময় পর্যাপ্ত পুষ্টি না পাওয়া মস্তিষ্কের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। বিশেষ করে আয়রন, আয়োডিন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ভিটামিনের অভাব শিশুদের আইকিউ কমিয়ে দেয়।
২. শিক্ষার নিম্নমান : বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মান অত্যন্ত নিম্নমানের। সমস্যা সমাধানের সক্ষমতা এবং সৃজনশীল চিন্তাভাবনার অভাব শিশুদের মেধার বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
৩. পরিবেশগত দূষণ : সিসা দূষণ, বিশেষত পুরোনো রং এবং অনিরাপদ পানির কারণে, শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয়। এটি শুধু গ্রামীণ নয়, শহরাঞ্চলেও একটি বড় সমস্যা।
৪. স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি : শিশুদের সাধারণ রোগবালাই এবং সংক্রমণের সঠিক চিকিৎসা না হলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা প্রভাবিত হয়।
৫. দারিদ্র্য : দরিদ্র পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুরা মানসিক এবং শারীরিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়। দারিদ্র্য শিক্ষার সুযোগ এবং মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা তৈরি করে।
আইকিউ উন্নয়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপগুলো হলো
১. পুষ্টি নিশ্চিত করা : গর্ভবতী মা ও শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আয়োডিনযুক্ত লবণ, আয়রন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং অন্যান্য ভিটামিন সরবরাহের জন্য জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচি চালু করা জরুরি।
২. শিক্ষার মানোন্নয়ন : প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার মান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সৃজনশীল ও গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা গেলে শিশুদের সমস্যার সমাধান করার সক্ষমতা বাড়বে।
৩. পরিবেশ দূষণ কমানো : পরিবেশে সিসা দূষণ কমাতে পুরানো রং এবং পানির উৎসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। পাশাপাশি দূষণের মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং জনসচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
৪. স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি : শিশুদের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি, টিকাদান কর্মসূচির প্রসার এবং মায়েদের জন্য প্রি-নেটাল এবং পোস্ট-নেটাল কেয়ার নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৫. দারিদ্র্য হ্রাস করা : সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এবং দরিদ্র পরিবারের জন্য বিশেষ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং মজুরি বৃদ্ধি করে দারিদ্র্য কমানো গেলে শিশুরা আরও উন্নত পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারবে।
৬. সচেতনতা বৃদ্ধি : পরিবার এবং সমাজের মধ্যে শিশুদের মানসিক বিকাশের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। খেলাধুলা, সৃজনশীল কার্যক্রম এবং মানসিক বিকাশে সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের গড় আইকিউ স্তর উন্নত করা কেবল ব্যক্তিগত মেধার বিকাশ নয়, বরং এটি জাতীয় উন্নয়নের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। একটি জাতির মেধা তার সামগ্রিক অগ্রগতির ভিত্তি। পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং পরিবেশগত দূষণ মোকাবিলার ক্ষেত্রে সমন্বিত ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করলে বাংলাদেশের গড় আইকিউ স্তরে উল্লেখযোগ্য উন্নতি আনা সম্ভব।
এক্ষেত্রে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যেখানে শিশু ও তরুণদের মানসিক এবং শারীরিক বিকাশের জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো এবং সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। পরিবার এবং সমাজকেও তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়ন, পুষ্টি নিশ্চিতকরণ এবং দূষণ রোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালানো হলে জাতির সামগ্রিক মেধা মান বৃদ্ধি পাবে। একসাথে কাজ করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানবসম্পদের মান বিশ্বমঞ্চে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে এবং দেশটি আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে।