আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল ছোড়ার সাত দিনের মাথায় এবার গোলা এসে পড়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে। এ ঘটনায় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের স্থানীয় লোকজনসহ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গত ২৮ আগস্ট মিয়ানমার থেকে একটি মর্টার শেল এসে পড়লে দেশটির রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সতর্ক করা হয়। এর মধ্যেই আবারও দেশটি থেকে গোলা এসে পড়ল।
মিয়ানমারের এ ঘটনায় বাংলাদেশ আরও বেশি সতর্ক অবস্থায় থাকবে বলে সিলেটে বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে বিভিন্ন আর্মস গ্রুপ সংঘাতে জড়িয়েছে। ভয় সে দেশের নাগরিকরা যখন নির্যাতিত হয়, তখন বাংলাদেশের দিকে চলে আসে। তবে যতই উস্কানি দেওয়া হোক, আর কোনো রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। আর এ ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হবে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানানো হবে।
গতকাল শনিবার সকালে তুমব্রু সীমান্ত ঘেঁষা নিজস্ব ভূখণ্ডের হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গোলা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়ে। এ ঘটনায় কোনো ধরনের হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। এর আগে গত রোববার একই এলাকায় মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার শেল পড়ার ঘটনায় ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূতকে ডেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। আর আজ রোববার আবারও মিয়ানমারের দূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানানো হবে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বিজিবি সদরদপ্তরের পরিচালক অপারেশন্স লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। ঘটনাটি সত্য প্রমাণিত হলে মিয়ানমারকে কড়া প্রতিবাদ জানাব। এর আগেও মর্টার শেল পড়ার ঘটনায় আমরা কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছি। সীমান্তের লোকজন যাতে ভয়ভীতিতে না থাকে, সে জন্য বিজিবি কাজ করছে। পাশাপাশি সীমান্তে বসবাসকারীদের সাবধানে চলাফেরা করতে সতর্ক করা হয়েছে।’
সীমান্তের বসবাসকারীরা জানান, সকাল সাড়ে ৯টার সময় নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের রেজু আমতলী বিজিবি বিওপির আওতাধীন সীমান্ত পিলার ৪০-৪১-এর মাঝামাঝি স্থানে মিয়ানমার সীমান্তের ওপারে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার টহল দেয়। সে সময় তাদের সেখান থেকে আনুমানিক ৩০ থেকে ৩৫টি গুলিবর্ষণ করতে দেখা যায়। এ সময় সীমান্ত পিলার ৪০ বরাবর আনুমানিক ১২০ মিটার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের ছোড়া দুটি গোলা পড়ে।
এদিকে গত পাঁচ বছর ধরে ওই সীমান্তের শূন্যরেখায় বসবাস করে আসছেন চার হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। সম্প্রতি মর্টার শেল ছোড়ার পাশাপাশি সীমান্তে হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণের ঘটনায় নোম্যান্স ল্যান্ডে থাকা রোহিঙ্গাদের আতঙ্কে দিন কাটছে।
রোহিঙ্গারা জানান, ঘুমধুম-তুমব্রু সীমান্তের এই কোনারপাড়া নোম্যান্স ল্যান্ডের আশপাশেই মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রতিদিন হেলিকপ্টারে টহল দেয়। এ সময় সেখান থেকে গুলিবর্ষণ চালাতে দেখা যায়। এ ছাড়া তাদের ক্যাম্পের কাছাকাছি সে দেশের কয়েকটি অস্থায়ী চৌকি রয়েছে। তারাও অনেক সময় পাহাড়ের দিকে গুলিবর্ষণ চালায়।
ওই সীমান্তের শূন্যরেখায় মিয়ানমারের অংশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা বৃদ্ধ আবদুল মালেক জানান, তাঁদের আতঙ্ক বাড়িয়েছে এ ঘটনা। তাঁর দাবি, কমপক্ষে ২০-৩০ রাউন্ড গুলির শব্দ প্রতিদিনই পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে রোহিঙ্গা শিবিরের নারী, পুরুষ ও শিশুসহ সবার মাঝে ভীতির মধ্যে আছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘মিয়ানমার প্রতিদিন এভাবে গুলি ছুড়তে থাকলে রোহিঙ্গারা ‘নোম্যান্স ল্যান্ড’ ছেড়ে বাংলাদেশে ঢুকে যাবে।’
রোহিঙ্গা মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘আজকের মতো এতগুলো গুলি ছোড়ার ঘটনা এই প্রথম। ভোর রাতে ক্যাম্পজুড়ে এক অন্যরকম ভীতিকর পরিস্থিতির তৈরি হয়। মিয়ানমারে আমরা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু মিয়ানমারের যে কার্যক্রম তারা চাইছে, আমরা এখান থেকেও চলে যাই। কিন্তু আমরা যাব কোথায়?’ প্রশ্ন তাঁর।
সীমান্তে বসবাসকারীদের মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে বান্দরবানের পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম তারিক বলেন, ‘সীমান্তে আমাদের অবস্থান বরাবরেই মতো সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে আজ দুবার গুলিবর্ষণ করেছে। এতে লোকজন ভয়ভীতির মধ্য রয়েছে। আমরা তাদের আশ্বস্ত করছি, তারা যাতে আতঙ্কিত না হয়। পাশাপাশি সীমান্তে নজরদারি বৃদ্ধি করেছি এবং আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।’
তুমব্রু সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দা মাহামুদুল হক জানান, মিয়ানমার হেলিকপ্টার থেকে আবারও গুলিবর্ষণ করছে। সীমান্তে তিন-চারবার হেলিকপ্টার দেখা গেছে। এতে সীমান্তের লোকজন ভয়ের মধ্য রয়েছে।
মিয়ানমারের এমন কর্মকাণ্ডে লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জাহাঙ্গীর আজিজ। তিনি জানান, ২০-২২ দিন ধরে এভাবে সীমান্তে গোলাগুলির বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে প্রতিদিন। পাশাপাশি প্রতিদিন সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে গোলাবারুদ নিক্ষেপের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে এপার থেকে। সীমান্তে বসবাসকারীরা ভয়ভীতির মধ্য রয়েছে। এমনকি এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস বলেন, ‘মিয়ানমারের হেলিকপ্টার থেকে থেকে ছোড়া দুটি গোলা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে পড়েছে বলে জেনেছি। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।’