নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরুর মধ্য দিয়ে পরমাণু বিদ্যুতের যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ। যদিও চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজকে আরো দীর্ঘায়িত করতে পারে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
প্রথমটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন না হলেও আরো একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য এরই মধ্যে পাঁচটি সম্ভাব্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এগুলোর যেকোনো একটিতেই স্থাপিত হবে দেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সম্ভাব্য স্থান নির্বাচনে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০২১ সালের জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত হয়। প্রকল্পের আওতায় প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত ১৫টি স্থানের ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ), বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ (বিএইআরএ) ও পরিবেশ অধিদপ্তরের (ডিওই) নির্দেশিকা অনুসরণ করে সেই সমীক্ষায় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য পাঁচটি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। যে পাঁচটি স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে—বরগুনার তালতলী উপজেলার নিশানবাড়ি (পূর্ব), বরগুনা সদর উপজেলার কুমিরমারা ও পদ্মা মৌজা, তালতলী উপজেলার নিশানবাড়ি (পশ্চিম), পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমোনতাজ ও রাঙ্গাবালী উপজেলার মৌডুবি।
এ পাঁচটি স্থানকে প্রার্থী সাইট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। সিসমিক ও টেকটোনিক স্টাডিজ, ভূতাত্ত্বিক, ভূ-প্রকৌশল ও ভূ-প্রযুক্তিগত স্টাডিজ এবং হাইড্রোলজিক্যাল অ্যান্ড হাইড্রোজোলজিক্যাল স্টাডিজের আলোকে এসব স্থানের প্রাধান্যতার ক্রম করা হয়েছে। সে অনুযায়ী বরগুনার তালতলী উপজেলার নিশানবাড়ি (পূর্ব) সাইটটি প্রথম স্থানে রয়েছে। এখন এ পাঁচটি স্থানের ওপর অধিকতর স্টাডি ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য কার্যক্রম সম্পাদনের লক্ষ্যে নতুন আরেকটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ চাহিদার কথা বিবেচনায় রেখেই এটি স্থাপনের বিষয়ে পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাংলাদেশে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা এ দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ফলে সামনের দিনগুলোতে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা আরো বাড়বে। কেবল একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে সেই চাহিদা জোগান দেয়া সম্ভব হবে না। সেজন্যই আমরা দ্বিতীয় আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে কাজ এগিয়ে নিচ্ছি।
তিনি আরো বলেন, দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে প্রথমে ১৫টি স্থান বাছাই করা হয়। প্রাথমিক মূল্যায়নে ১৫টির মধ্য থেকে পাঁচটি চিহ্নিত করা হয়েছে। এখন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত মাপকাঠি অনুযায়ী বিস্তারিত সমীক্ষা করা হবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কার্বন নিঃসরণ কম হয়। পর্যায়ক্রমে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উৎপাদনে যাওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই প্রেক্ষাপটে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার তুলনায় চাহিদা কম কিন্তু বর্তমান সক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটা ও ভবিষ্যতে চাহিদা বৃদ্ধির কথা চিন্তা করেই দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।
দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। পাবনা জেলার রূপপুরে প্রকল্প এলাকার জন্য প্রায় ২৬০ একর এবং আবাসিক এলাকার জন্য ৩২ একর জমি অধিগ্রহণ করে ভূমি উন্নয়ন, অফিস, রেস্ট হাউজ এবং বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন নির্মাণসহ ৭২টি আবাসিক ইউনিটের নির্মাণকাজও আংশিকভাবে সম্পন্ন হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নের অনেক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর তত্কালীন সরকার ১৯৬৩-৬৯ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দিলেও পরবর্তী সময়ে এ-সংক্রান্ত সব কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে সেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। ১৯৯৬ সালে তত্কালীন সরকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। এজন্য ১৯৯৬ সালে প্রণীত জাতীয় জ্বালানি নীতিতে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে বাংলাদেশ নিউক্লিয়ার অ্যাকশন প্ল্যান অনুমোদিত হয়। ২০০৯ সালের ১৩ মে বাংলাদেশ সরকার ও রাশিয়ান ফেডারেশনের মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক একটি সমঝোতা সই হয়।
এরপর বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে ২০১১ সালে রূপপুরে প্রতিটি আনুমানিক এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্ন দুই ইউনটবিশিষ্ট পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনসংক্রান্ত সহযোগিতা চুক্তি সই হয়। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে সহযোগিতা দিচ্ছে রাশিয়ার আণবিক শক্তি করপোরেশন রোসাটম। প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ এবং ব্যবহারের পর উত্পন্ন বর্জ্য ফেরত নিয়ে যাওয়ার কথা সংস্থাটির।
রূপপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পারমাণবিক চুল্লিটি নির্মিত হয়েছে রাশিয়ায়। ভিভিআর-১২০০ মডেলের এ রিঅ্যাক্টরে পরমাণু জ্বালানি পুড়িয়ে মূল শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। প্রাথমিক পরিকল্পনায় জানানো হয়েছিল যে রূপপুরের প্রথম ইউনিটটি ২০২৩ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে পারবে। এ কেন্দ্র নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে।
এদিকে, রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ সম্পন্নের পরও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি। এখন পর্যন্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, জরিপ ও কিছু নকশা তৈরি ছাড়া সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ তেমন একটা এগোয়নি। বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, সঞ্চালন লাইন সময়মতো নির্মাণ না হলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাবে না। সেক্ষেত্রে বৃহৎ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখতে হবে। এর বিপরীতে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে গুনতে হবে বিপুল পরিমাণ অর্থ। আর্থিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি।
তাদের ভাষ্যমতে, নির্ধারিত সময়ে গ্রিডলাইনের নির্মাণকাজ সম্ভব না হলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বিলম্বিত হতে পারে।পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ফুয়েল লোড করার কথা। তার আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অবশ্যই গ্রিড লাইনের কাজ শেষ করতে হবে। যদি তা না করা যায় তাহলে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো রূপপুরকেও সঞ্চালন লাইনের জন্য বসিয়ে রাখতে হবে।
দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত এখনো গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। তবে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ সীমিত হয়ে আসছে। অন্যদিকে গ্যাসের চাহিদা ক্রমবর্ধমান। এ চাহিদা মেটাতে উচ্চমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে সরকার। গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতি বছরই ক্রমান্বয়ে এলএনজির আমদানি বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বমুখী আমদানিনির্ভর এ পণ্যটির দাম। এতে এলএনজি আমদানিতে ব্যয়ও বাড়ছে। পরমাণু বিদ্যুৎ গ্যাসনির্ভরতা কাটাতে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
বিএসডি/ এফএস