কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হচ্ছে না বছর পাঁচেক হলো। বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় নেই কমিটি। অনেক জেলায় আংশিক কমিটি দিয়েই পার হচ্ছে বছরের পর বছর। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম-জাতীয় স্থায়ী কমিটিতেও অনেকদিন ধরে একাধিক পদ শূন্য। এ নিয়ে কানাঘুষা মাঝেমধ্যেই প্রকাশ্যে আসে। করোনায় কয়েক মাস বন্ধ থাকলেও ফের শুরু হয়েছে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম। তবে পর্যাপ্ত সময় পেয়েও দলকে ঢেলে সাজাতে অনেকটাই ব্যর্থ একযুগ ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি। দীর্ঘদিন কমিটি না থাকায় হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে দলের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনেও। বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে গণতান্ত্রিক উপায়ে গত বছর ছাত্রদলে নতুন নেতৃত্ব এলেও পূর্ণতা পায়নি সংগঠনটি। তৃণমূলে পুনর্গঠন আটকে আছে বিভিন্ন অজুহাত আর অভিযোগে। পদ বাগিয়ে নিতে টাকার লেনদেনসহ স্বজনপ্রীতির পুরনো অভিযোগ তো আছেই। যে কারণে পরীক্ষিত ও মামলায় জর্জরিত নেতাকর্মীরা অনেক জায়গায় পদ পাচ্ছেন না। ফলে এ নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভ বাড়ছে। সম্প্রতি সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে তৃণমূল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় বিএনপি হাইকমান্ড। কিন্তু সেই উদ্যোগ বাস্তবে ফলপ্রসূ হচ্ছে না বলে জানা গেছে। আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার সময় প্রতিটি জেলার শীর্ষ নেতাদের বিএনপির কেন্দ্র থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তিন মাসের মধ্যে অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে হবে। কিন্তু মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলে যায়, পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয়নি। আহ্বায়ক কমিটিতেই নির্দিষ্ট মেয়াদ পার হয়ে যায়। বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলা শাখার মধ্যে ২৭টিতে আহ্বায়ক কমিটি আছে। এগুলোরও মেয়াদ শেষ। রাজশাহী মহানগর, বরিশাল মহানগর ও পটুয়াখালীসহ বেশ কিছু জেলা শাখা বহু আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও এখন পর্যন্ত নতুন কমিটি গঠন করতে পারেনি। পুনর্গঠনের কাজও চলছে ধীরলয়ে। করোনা মহামারির কারণে প্রায় ছয় মাস কমিটি গঠন ও পুনর্গঠনসহ সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে আবার শুরু করেছে বিএনপি। তাদের সব পুনর্গঠনের কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চায় দলটি।
অন্যদিকে তোড়জোড় থাকলেও এ বছর হচ্ছে না দলের কেন্দ্রীয় কাউন্সিল। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল হয়। এরপর ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন কারাগারে যাওয়ায় আর কাউন্সিলের আয়োজন করতে পারেনি বিএনপি। তবে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কথা অনুয়ায়ী আগামী বছর দলের সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল করার চিন্তা-ভাবনা করছেন তারা। এ লক্ষ্যে সারা দেশে কমিটি পুনর্গঠনের কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে চায় বিএনপি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কমিটি দিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের মৌখিকভাবে নির্দেশনাও দিয়েছে দলের হাইকমান্ড। কিন্তু সে অনুয়ায়ী কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে তৃণমূলে। চলতি মাসে অনেক জায়গায় কমিটি দেওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জ, লক্ষ্মীপুর ও ফরিদপুরে এক বছরের বেশি সময় ধরে বিএনপির জেলা কমিটি নেই। এগুলোতে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কাজ চলছে কয়েক মাস ধরে কিন্তু ঘোষণা হচ্ছে না কমিটি। নতুন কমিটি দিতে না পারলেও বিভিন্ন কারণে বহিষ্কারের ঘটনা ঘটছে।
তৃণমূলে দীর্ঘদিন ধরে কমিটি না থাকায় অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ছে দল। এ কারণে ওই জেলার তৃণমূলের নেতাকর্মীরা দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। চেইন অব কমান্ডও নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে। তবে বিএনপির নেতারা বলেছেন, সাংগঠনিক কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। করোনার কারণে সাংগঠনিক কার্যক্রম দীর্ঘদিন স্থগিত থাকার পর তা আবার শুরু হয়েছে। যথাসময়ে পুনর্গঠনের কাজ শেষ করা হবে। পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় কাউন্সিল করতে না পারার পেছনে সরকারের দমন-পীড়নকেও দুষছেন তারা।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স জানান, বাস্তব দিকটাও আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে। প্রথমত পরিবেশ অনুকূলে নেই। এক মাস হলো সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এখনও স্বাভাবিক নয়। করোনায় আট মাসে একটা জট ছিল। এর আগেও অনেক জায়গায় দীর্ঘদিনের জট ছিল। হাইকমান্ডের নির্দেশনা অনুয়ায়ী তা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন সরকারের হামলা-মামলা সহ্য করে দলের বেশিরভাগই তো ত্যাগী নেতা। সবাই তাদের কর্মেও মূল্যায়ন চান। কিন্তু আমাদের সমন্বয় করে রেজাল্ট বের করতে হয়। কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের আগে চেষ্টা করছি সব উপজেলা ইউনিয়নে নতুন নেতৃত্ব দিতে। ক্ষমতাসীনরা অনেক জায়গায় কাউন্সিল করতে নানাভাবে বাধা দেয় বলে অভিযোগ তার।
দলের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, করোনার কারণে আমাদের সব সাংগঠনিক কাজই বন্ধ ছিল। এখন আবার স্বাভাবিক হয়েছে। সব মিলিয়ে একটু সময় লাগছে। দল পুনর্গঠনের বিষয়ে রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু বলেন, উত্তরের কয়েকটি জেলার নেতারা খুব ভালো কাজ করছেন। বিভাগের অর্ধেক পুনর্গঠনের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী এক মাসের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি। তবে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ঢিলেমিতে ক্ষুব্ধ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমার নির্বাচনি এলাকায় যাকে ছাত্রদলের সভাপতি দেওয়া হয়েছে, আমিই তাকে চিনি না। এ চিত্র দেশের অনেক জায়গায়।
সংগঠন পুনর্গঠন চলছে জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের কমিটিও হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে জেলা বিএনপির অসম্পূর্ণ কমিটিগুলোও করা হবে। কমিটি করতে গিয়েও সরকারের বাধার মুখে পড়তে হয়। কোথাও সভা-সমাবেশও করতে দেয় না তারা। তারপরও নানা প্রতিকূলতায় সাংগঠনিক পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ^^বিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আগে দলের ভেতর গণতন্ত্র ফেরাতে হবে। গণতন্ত্রের সঠিক বার্তা নিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছাতে হলে আগে নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে হবে। বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বই গণতান্ত্রিক নয়। পরিবারতান্ত্রিক বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে সাংগঠনিক অবস্থা আরও ক্ষয়িষ্ণু হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সবার আগে দলে মনোনয়ন ও কমিটি বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। মাঠের কর্মীদের মূল্যায়ন না করলে মাঠ ফাঁকা থাকবে। মাঠে নামার মতো কর্মী পাওয়া যাবে না।
পূর্ববর্তী পোস্ট