ডা. ফারহানা মোবিন
বর্তমানে করোনাভাইরাসের জন্য সারা পৃথিবীর মানুষই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। দুঃখ, কষ্ট, দুশ্চিন্তা আমাদের হৃদপিণ্ড ও মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই সুস্থ থাকতে হলে হৃদপিণ্ড ও মন ভালো রাখতে হবে।
হৃদপিণ্ড আমাদের দেহের ভীষণ জরুরি একটি অঙ্গ। আমাদের সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করে এই হৃদপিণ্ড। আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখনও এটি কাজ করতে থাকে। এক সেকেন্ডের জন্যও তার কাজ বন্ধ হয় না।
মায়ের পেটে থাকাকালীন সময় থেকেই আমাদের হৃদপিণ্ড তৈরি হওয়া শুরু হয়। বাম পাশের বগলের গোড়া থেকে তিন বা চার ইঞ্চি দূরে আমাদের হৃদপিণ্ডের অবস্থান।
হৃদপিণ্ডের কাজ অনেকটা পানির পাম্পের মতো। পানির পাম্প বিশাল একটা দালানের নিচে থেকে সবচেয়ে উপরের অংশে পানি সরবরাহ করে। আমাদের দেহে হৃদপিণ্ড নামের জরুরি অঙ্গটি ঠিক সেই কাজটিই করে। পায়ের আঙ্গুল থেকে মাথা পর্যন্ত রক্ত পৌঁছে দেয়। পানির পাইপ লাইনে পানির ময়লা জমলে, পানি সঠিকভাবে চলাচল করতে পারে না। ঠিক তেমনি আমাদের শরীরের শিরা উপশিরাতে ময়লা জমলে, রক্ত সঠিকভাবে চলতে পারে না। এখানে রক্তের ময়লা বলতে রক্তের মধ্যে জমে যাওয়া চর্বিকে বোঝায়।
রক্তনালীতে জমে থাকা চর্বি বা ফ্যাট তৈরি হয় দেহের তুলনায় অধিক পরিমাণে চর্বি জাতীয় খাবার, মাদক দ্রব্য, ধূমপান থেকে। বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে, হৃদপিণ্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হয়। তখন হৃদপিণ্ড সারা দেহে সঠিকভাবে রক্ত সরবরাহ করতে পারে না। পরিণামে তৈরি হয় হৃদপিণ্ডের নানাবিধ অসুখ। যা কখনোই কাম্য নয়।
হৃদপিণ্ডের অসুখের জন্য দায়ী বিষয়গুলো হলো:
১. অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও অক্লান্ত পরিশ্রম।
২. ভয়ানক দুশ্চিন্তা ও হতাশা।
৩. বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন বেশী।
৪. দীর্ঘ বছর সঠিকভাবে ঘুমের অভাব।
৫. কোন ওষুধের দীর্ঘ বছরের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
৬. অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ।
৭. কিডনীর জটিল অসুখ।
৮. মাদক দ্রব্য সেবন ও অতিরিক্ত ধূমপান। সিগারেটের নিকোটিন রক্তনালীর সংকোচন করে। ফলে হৃদপিণ্ডে রক্ত সরবরাহ কমে যায়।
৯. পারিবারিক ইতিহাস অর্থাৎ রক্তের আত্মীয় স্বজনদের হৃদরোগ থাকলে, আপনার হৃদরোগ হতে পারে। যদি আপনি সঠিকভাবে নিজের যত্ন না নেন।
১০. কোন জটিল রোগের জন্যও হৃদপিণ্ডের অসুখ হতে পারে।
১১. হৃদপিণ্ডের অপারেশন বা কোন অসুখের পরে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে না চলা।
হৃদপিণ্ড ভালো রাখার জন্য আমাদের করণীয়:
১. বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
২. অতিরিক্ত মিষ্টি ও চর্বি জাতীয় খাবার, মাদক দ্রব্য, ধূমপান পরিহার করতে হবে।
৩. ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৪. জীবন মানেই একটার পর একটা যুদ্ধ। মানসিক চাপ কমাতে নিয়মিত নিজেকে খুশী রাখা উচিত।
৫. ধর্মের কাজ, মেডিটেশন মানসিক প্রশান্তি দেয়। হৃদপিণ্ড ভালো রাখার জন্য মানসিক প্রশান্তি ভীষণ জরুরী।
৬. পারিবারিক ইতিহাসে কারো এ অসুখ থাকলে, আগে থেকেই সচেতন হোন।
৭. হার্টের অসুখ থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নিয়মিত চেক আপ করানো ভীষণ জরুরী।
৮. প্রতি বছর পুরো দেহের চেকআপ করান। আমাদের দেহ বিশাল এক কারখানা। একটা মেশিন দূর্বল হলে, আশেপাশের মেশিনে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। তাই সময় থাকতে সচেতন হোন।
৯. অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার খাবেন। নিয়মিত দুই লিটার পানি ভীষণ জরুরী। যারা রোযা রাখবেন তারা ইফতারে অতিরিক্ত তেল, মশলা, চর্বি জাতীয় খাবার বাদ দিবেন।
১০. সুযোগ হলেই হাটবেন।
করোনা ভাইরাসের জন্য লকডাউনে থেকে ঘরের কাজ গুলো নিয়মিত করার চেষ্টা করবেন ( ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোয়া …………)। এতে ঘামের মাধ্যমে শরীরের বাড়তি ক্যালোরিগুলো ঝরে যায়। যা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
১১. সঠিক সময়ে ঘুমানোর চেষ্টা করবেন।
১২. সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা হার্টের জন্য ভালো। তবে হৃদরোগ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করবেন।
১৩. হতাশা দূর করতে নিজেকে সৃষ্টিশীলতা ও মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত রাখবেন। ভালো কাজ আমাদেরকে দেয় আত্মতৃপ্তি। মন ভালো থাকলে, হার্ট ভালো থাকবে।
হার্ট ভীষণ জরুরী অঙ্গ। আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখনও আমাদের হৃদস্পন্দন ( heart beat ) সচল থাকে। হার্ট বিট থেমে গেলে আমাদের জীবনটাও থেমে যাবে। তাই আমাদের সবার উচিত হার্ট ভালো রাখার উপায়গুলো মেনে চলা এবং অন্যদের সচেতন করা।
ডা. ফারহানা মোবিন
লেখক ও চিকিৎসক
বারডেম হাসপাতাল,ঢাকা।