নিজস্ব প্রতিবেদক:
মস্তিষ্কের বাঁ পাশে রক্ত জমাট বেঁধেছিল ৩২ বছর বয়সী সুমনের। এতে এক পাশে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দ্রুত তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করে এনজিওগ্রাম করা হয়। পরীক্ষায় মস্তিষ্কের প্রায় ৮০ ভাগে রক্ত চলাচল বন্ধ পাওয়া যায়। তবে আধুনিক চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় বেঁচে যান তিনি। এখন তিনি অনেকটা সুস্থ।
হাসপাতালের নিউরোসায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সুমন রানা বলেন, একসময় ধারণা ছিল, স্ট্রোক কেবল বয়স্ক মানুষের হয়। আসলে তা নয়। বর্তমানে তরুণেরাও এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই অল্প বয়সীদের স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে জানিয়ে চিকিৎসক সুমন বলেন, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা, ফাস্ট ফুড ও মাদক গ্রহণের ফলে তরুণদের বড় একটি অংশ ডায়াবেটিসে ভুগছে। অনেকে কম বয়সে চাপ নিচ্ছেন, এতে মানসিকভাবে প্রভাব পড়ছে। তরুণদের মধ্যে যাঁরা সেবা নিতে আসেন, তাঁদের অধিকাংশই রক্তক্ষরণজনিত।
এই চিকিৎসক বলেন, মাসে কিংবা বছরে কী পরিমাণ তরুণ ঢাকা মেডিকেলে সেবা নিতে আসেন, সেই পরিসংখ্যান তাঁদের কাছে নেই। তবে আগের তুলনায় এই হার অনেক বেড়েছে।
স্ট্রোক সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছরের মতো এ বছরও আজ শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) স্ট্রোক দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘না করলে সময় ক্ষেপণ, স্ট্রোক হলেও বাঁচবে জীবন’।
গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকান নিউরোলজি একাডেমির প্রকাশিত গবেষণায় বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত তরুণদের স্ট্রোকের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। তরুণদের ক্ষেত্রে স্ট্রোক করোনার প্রথম লক্ষণ হিসেবে বিবেচনায় আসছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, স্ট্রোক মৃত্যুর দ্বিতীয় ও বিকলাঙ্গের তৃতীয় কারণ। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৭০ ভাগ দেশেই স্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। এসব দেশের ৮৭ ভাগ মৃত্যু ও বিকলাঙ্গের প্রধান কারণ স্ট্রোক।
ডব্লিউএইচও বলছে, বিশ্বে প্রতিবছর দেড় কোটি মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়, যাদের ৩০ ভাগের মৃত্যু হয়। আর প্রায় ৬০ ভাগ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস ও নিয়মমাফিক জীবনযাপনে ৯০ ভাগ স্ট্রোক প্রতিরোধ সম্ভব। দ্রুত চিহ্নিত করা গেলে ৭০ ভাগের বেশি রোগী বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ঢাকা মেডিকেলের নিউরো সায়েন্স বিভাগের গবেষণা বলছে, দেশে গত ৪০ বছরে স্ট্রোক বেড়েছে শতভাগ। বর্তমানে প্রতি চারজনে একজন স্ট্রোকের ঝুঁকিতে আছেন। অন্যদিকে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে স্ট্রোকের মাত্রা কমেছে ৪২ শতাংশ। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে স্ট্রোকের মোট রোগীর ৮০ ভাগই হবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম বলেন, উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের ৪৮ শতাংশই স্ট্রোকের ঝুঁকিতে রয়েছেন। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কারণে ৩৬ শতাংশ স্ট্রোকের শিকার হচ্ছেন। জাঙ্কফুডে আসক্তির কারণে ২৩ শতাংশ ঝুঁকিতে থাকেন। এ ছাড়া স্ট্রোকে আক্রান্ত ১৯ শতাংশের দেহে অতিরিক্ত মেদ এবং ১৭ শতাংশ মানসিক চাপে ভোগেন।
এই মরণ ব্যাধির ভয়াবহতা বাড়লেও দেশে চিকিৎসা সুবিধা এখনো কম। ঢাকা মেডিকেলসহ রাজধানীর নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে অনেকটা কার্যকরী সেবা পাওয়া গেলেও চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। স্ট্রোক হলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দিলেও বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নেই প্রাথমিক সেবাকেন্দ্র। এতে করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কেউ আক্রান্ত হলে রাজধানীতে আসার পথে, আবার কেউবা হাসপাতালের জরুরি বিভাগেই মারা যাচ্ছেন।
মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হলে কিংবা রক্তনালি ছিঁড়ে গেলে স্নায়ুকোষে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। রক্তনালিতে চর্বি জমে সরু হয়ে যে স্ট্রোক হয়, সেটি ইসকেমিক স্ট্রোক। আর রক্তনালি ফেটে রক্তক্ষরণ হলে সেটিকে হেমোরেজিক স্ট্রোক বলে। দ্বিতীয়টিতে মৃত্যু ঝুঁকি বেশি হলেও আমেরিকান স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের জরিপ অনুযায়ী, ৮৭ ভাগ স্ট্রোকই ইসকেমিক ধরনের হয়ে থাকে।
বিএসডি /আইপি