বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি থমকে দাঁড়িয়েছে? হয়তো থমকে দাঁড়িয়েছে। কোভিড–ঝড়টা এখনো আসেনি, কিছু দমকা বাতাস বইছে। কিন্তু কোভিড–আতঙ্কে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থমকে দাঁড়াল কেন?
প্রথমে বলি, কেন বলছি থমকে দাঁড়িয়েছে। দেশের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকে চিকিৎসাসেবার যে ব্যবস্থা, তার কতভাগ এখন চালু আছে? ডাক্তারদের চেম্বার একটা বিশাল অংশ মানুষের চিকিৎসা দেয়, দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার একটা বড় অংশের ভার বহন করে। চিকিৎসাসেবার এই পুরো অংশটাই জনগণের কাছে আর এখন উন্মুক্ত নয়। সরকারি হাসপাতালগুলো খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে।
আজ একজন মানুষের যদি ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়া হয় বা সেপসিস হয়, তিনি কোথায় যাবেন? কোথায় তিনি ভর্তি হবেন? কোন ডাক্তার দেখাবেন? সেপসিসে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায়—সেপসিসের লক্ষণও তো জ্বর আর শ্বাসকষ্ট। এই রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার, এক ঘণ্টার মধ্যে আইভি অ্যান্টিবায়োটিক দরকার, কোথায় তিনি যাবেন?
একজন রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে হার্টের কারণে। তাঁর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দরকার, ভর্তি দরকার হয়তোবা ঢাকায় এসে এনজিওগ্রাম-ইকো দরকার। সবটা বন্ধ হয়ে আছে—যা হচ্ছে সীমিত পরিসরে, তার আওতা খুবই সামান্য!
এগুলো হচ্ছে পুরো কোভিড–ধাক্কাটা আসার আগের অবস্থা। নিউইয়র্ক বা মিলানের অবস্থা ঢাকায় হলে কী হবে? প্রতিদিন যদি ১০ হাজার হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়, কীভাবে সামাল দেবেন?
এই যে কীভাবে সামাল দেবেন বা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থমকে দাঁড়াল কেন, তার উত্তর কে দেবে? এর দায় কি চিকিৎসকদের? নাকি সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য আমলাতন্ত্রের, না রাজনৈতিক নেতৃত্বের? একটা বিশাল অংশ মানুষ না ভেবেচিন্তেই চিকিৎসকদের দোষ দেবে, রাজনৈতিক মতাদর্শ বিশেষে কেউ রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায়ী করবে। দেশের বিশাল একটা স্বাস্থ্য ব্যুরোক্রেসি আছে, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে, ওঁরা কিন্তু রাডারের বাইরে রয়ে যাবেন।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাস্থ্য খাতের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো হয়তে জানেন না, বোঝেন না। স্বাস্থ্য প্রশাসনের দায়িত্ব হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দিয়ে দরকারি কাজগুলো করিয়ে নেওয়া। দেশের স্বাস্থ্য প্রশাসন জনস্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাসেবা পর্যন্ত বিস্তৃত—তাদের প্রথমত নিজেকে শিক্ষিত করতে হয় এই বিষয়ে, নিজেকে দায়বদ্ধ করতে হয় দেশের কাছে, সমাজের কাছে।
অনেক সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং স্বাস্থ্য প্রশাসনের স্বার্থ বিপরীতধর্মী হতে পারে। এই সময় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নেতৃত্বের দায়িত্ব হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রভাবিত করা। আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নেতৃবৃন্দ যা চাচ্ছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প তার উল্টোটা করছিলেন বা করতে চাচ্ছিলেন। তখন ফাউচি, রেডফিন বা বার্কস-এর মতো স্বাস্থ্য নেতৃবৃন্দ ট্রাম্পকে বুঝিয়ে–সুঝিয়ে যা দরকার তা করিয়ে নিয়েছেন, এখনো নিচ্ছেন।
তো বাংলাদেশের বেলায় স্বাস্থ্য প্রশাসনের অংশীদার কারা? আমি বলব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওষুধ অধিদপ্তর, দেশের পাবলিক হেলথ অথরিটি, দেশের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধানেরা এবং বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবরেটরিগুলোর স্বত্বাধিকারীরা।
দেশে প্যান্ডেমিক প্রস্তুতি কী ছিল? ছিল না? না থাকলে তার দায় স্বাস্থ্য প্রশাসনের। দেশে পিপিই সরবরাহ বা মজুত ছিল? পিপিই প্রশিক্ষণ ছিল? যদি না থাকে তার দায় স্বাস্থ্য প্রশাসনের। দেশে উপজেলা পর্যায়ে প্যান্ডেমিক ব্যবস্থাপনার নির্দেশনা আছে কি? না থাকলে দায় কে নেবেন, উপজেলা কমপ্লেক্সের চিকিৎসক, না আমাদের স্বাস্থ্য প্রশাসন?
আমাদের কি পর্যাপ্ত নেগেটিভ ফ্লো আর আইসোলেশন রুম আছে জেলা আর উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত? কে উত্তর দেবে? উপজেলা চিকিৎসক নেতৃবৃন্দ, না সিভিল সার্জন, না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়? উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তো ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার!
যথেষ্ট ওষুধ কি মজুত আছে? ভেন্টিলেটর ও ডায়ালাইসিস মেশিন? এই সাপ্লাই চেইনের দায়বদ্ধতা কার—কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের ডিউটি ডাক্তারের, না ওষুধ অধিদপ্তরের?
আপনাদের কোয়ারেন্টিন পলিসি কী? এক হাসপাতালে একজন রোগী পজিটিভ ধরা পড়লে আপনারা পুরো হাসপাতাল শাটডাউন করে দিয়ে সব চিকিৎসককে কোয়ারেন্টিনে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এটা করলে তো করোনাভাইরাস লাগবে না; আমরা নিজেরাই নিজেদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ধস নামিয়ে দেব। ডব্লিউএইচও গাইডলাইন ফলো করলে তো ব্যাপারটা আরও বাস্তবিকভাবে সামলানো যায়। ডব্লিউএইচও সংজ্ঞায়িত হাই রিস্ক এক্সপোজার ছাড়া মিডিয়াম আর লো রিস্ক এক্সপোজার যাঁদের হয়েছে, তাঁদেরকে কাজ চালিয়ে যেতে বলুন এবং প্রতিদিন লক্ষণ ও তাপমাত্রা পরিমাপ করুন।
আমি বিশ্বাস করি না বাংলাদেশের চিকিৎসকেরা সম্মুখ সমরে নামতে ভয় পান। তাঁদের পিপিই নিয়ে অনেক শঙ্কা কাজ করে, ওঁদের অনেকেই পিপিই কনসেপ্ট নিয়ে পুরো ওয়াকিবহাল নন। যাঁরা ফ্রন্টলাইনে আছেন, তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত মতবিনিময় করুন। তাঁদের দরকার সেলফ প্রোটেকশন ট্রেইনিং, পিপিই পরার ট্রেইনিং, যাঁরা সংক্রমিত হবেন ওঁদের সেরা চিকিৎসা নিশ্চিত করুন।
আমাদের স্বাস্থ্য আমলাতন্ত্রের বেসরকারি অংশীজনদেরও এগিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি খাতে কিছু হাসপাতালকে তৈরি হতে হবে।
আমরা এখনো মাত্র দমকা হাওয়ার আভাস পাচ্ছি। জানি না কোভিড–ঝড় আমাদের ওপর দিয়ে যাবে কি না। জানুয়ারি থেকে আজ এপ্রিলের শেষ পর্যায়ে। আমরা কি এই চার–পাঁচ মাস সময় ভালোভাবে ব্যবহার করেছি? এখন কোভিড–ঝড় পুরো শক্তি নিয়ে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে, দিনে ১০ হাজার রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন পড়লে অথবা একই সঙ্গে কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের কিছু জরুরি ডাক্তার-নার্স অসুস্থ হয়ে পড়লে বা কোয়ারেন্টিন হয়ে গেলে আপনারা কীভাবে সামাল দেবেন?
আপনাদের প্ল্যান বি কী? প্ল্যান সি? প্ল্যান ডি?
আবারও বলি, চিকিৎসকেরা ওঁনাদের কাজ করুন রোগীর পাশে, রাজনীতিবিদ তাঁদের ব্যাপার নিয়ে থাকুন। কিন্তু আপনি যদি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য প্রশাসনের অংশ হন, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার ধস প্রতিরোধ করা আপনার দায়িত্ব।
*রুমি আহমেদ খান: যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত এবং ট্রেনিং প্রোগ্রামের পরিচালক। মেডিসিনের (রেসপিরেটরি ও আইসিইউ) সহযোগী অধ্যাপক।