নিজস্ব প্রতিবেদক
তিনদিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্বোধন করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তাকে প্রধান অতিথি হিসেবে সম্বোধন করা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, এখানে আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে বলাতে আমি একটু কষ্ট পেলাম। এ খেলার মাঠ থেকে আমাকে যেন বাইরে রাখা হলো। হওয়া উচিত ছিল খেলার ক্যাপ্টেন কিন্তু আমাকে করলেন অতিথি।
রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে এ সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই সংস্কার কমিশনের যারা আছেন, তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন সংস্কারটা যেন এমনভাবে হয়, ভবিষ্যতের প্রজন্মরা যাতে আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে। কতটুকু আমরা গ্রহণ করবো, কত দ্রুত গ্রহণ করবো, কীভাবে অগ্রসর হবো। এটাতো ওনাদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে রচনা। এখন আপনাদের অভিজ্ঞতা, আপনারা যেহেতু জনগণের নেতা, আপনাদেরকেই প্রতিনিয়ত আইনগুলো, নিয়মগুলো, প্রতিষ্ঠানগুলো মোকাবিলা করতে হবে। সে জন্য আপনাদের সামনে দেওয়া হলো, আলোচনা শুরু করার জন্য। আলোচনাটা একাডেমিক আলোচনা না, বাস্তব আলোচনা।
ড. ইউনূস বলেন, সবার স্বপ্ন আমরা এমনভাবে মজবুত করে বানাবো, যা সবাই মেনে চলবে। এই মেনে চলার মাধ্যমে আমরা একটা সুন্দর সমাজ, সুন্দর রাষ্ট্র উপহার দিতে পারবো। সে উদ্দেশ্যেই আজকের সভা। আমাদের মধ্যে ঐক্যমত সৃষ্টি হলে আমরা সেগুলো কাজে লাগাতে পারি। এবার কাজে লাগালে সেটা বংশ, প্রজন্ম পরম্পরায় চলতে থাকবে। একটা সুন্দর দেশ আমরা পাবো। এই ভাবনা থেকেই আমরা এগুলো গ্রহণ করবো।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আলোচনাটা কত সুন্দর হবে, কত মসৃণ হবে সেটা আপনাদের ওপর নির্ভর করবে। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সুপারিশগুলো উপস্থাপন করবো। কমিশনের সদস্যরা এখানে এগুলো ব্যাখ্যা করবেন। চাপিয়ে দেওয়ার জন্য না, চাপানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা শুধু আপনাদের বোঝানোর জন্য। আপনাদের সহযোগিতা চাই এটা আমি বলবো। কারণ এটা আপনাদের কাজ। এটা আমার কাজ না, একার কাজ না। যেহেতু আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন আপনাদের বলতে সমাজের কল্যাণে কোনো কোনো জিনিস করতে হবে, কীভাবে করতে হবে। যেটা এখনই করা যাবে বলবেন, এটা এখনই করা দরকার, সামান্য রদবদল থাকলে বলবেন সামান্য রদবদল করে দেন, সেটা আপনাদের ইচ্ছা। আমরা শুধু সাচিবিক কাজগুলো আপনাদের করে দিলাম।
একটা লন্ডভন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নিয়েছে জানিয়ে ড. ইউনুস বলেন, চেষ্টা করেছি এটাকে কোন রকমে সফল করার। এই ৬ মাসের যে অভিজ্ঞতা সেটা আমাদের সবাইকে প্রচণ্ড সাহস দেবে। এই ৬ মাসের অভিজ্ঞতা হলো আমাদের সবাইকে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষসহ রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সবাই সমর্থন দিয়েছে। এই অন্তর্বর্তী সরকারকে। আমাদের মধ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক করার, দূরত্ব সৃষ্টি করার মতো প্রবণতা আছে। কিন্তু এই একটি জায়গায় এক ছিলাম, এখনো এক আছি। আগামীতেও আমরা এক থাকবো। সে বিশ্বাস আমার আছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যেভাবে আমরা প্রথম অধ্যায় শেষ করলাম, দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা যদি সেটা ঠিক রাখতে পারি, তৃতীয় অধ্যায়ের জন্য আমাদের কোনো চিন্তা নেই। প্রথম অধ্যায়ে যে সমস্ত শক্তি আমাদের ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে, আমাদের ভন্ডুল করার চেষ্টা করেছে, তাদেরকেও সুন্দর ভাবে, সবাই মিলে মোকাবেলা করতে পেরেছি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, হাঙ্গামা হবে, কারণ যাদেরকে বাংলাদেশের মানুষ ত্যাগ করেছে। প্রতিটি দিন তাদের জন্য মূল্যবান, দেরি হলে তাদের জন্য অসুবিধা। সেজন্য আমাদের সবাইকে শক্ত থাকতে হবে, মজবুত থাকতে হবে। আমরা যেগুলো আলাপ করছি, সেগুলোতে মতভেদ থাকবে কিন্তু এর অর্থ এই নয় আমরা একত্র নই। আমরা একত্র থাকবো। একসঙ্গে আপনাদের সমর্থন, আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন, সারা পৃথিবী জুড়ে আমাদের একটা বড় রকম সমর্থন গড়ে উঠেছে যে কারণে অপর পক্ষ সুবিধা করতে পারছে না। যেখানে যায় পদে পদে ব্যাহত হচ্ছে। বহু গল্প করছে, গল্প টেকাতে পারছে না। শেষমেষ তো ট্রাম্পকে নিয়ে গল্প, সে অপপ্রচার চালাতে গিয়েও পারলো না।
ছোট রাষ্ট্র, বড় রাষ্ট্র, মাঝারি রাষ্ট্র, ধনী রাষ্ট্র, সবাই মিলে সমর্থন দিয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কারো কোন দ্বিধা নেই। তাদের ভাষা শুনলে আমি অবাক হই। আমরা যখন বসি, বিস্তারিত জানার আগে বলে, আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। এ পর্যন্ত তারা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং ক্রমাগতভাবে তাদের সমর্থন বাড়ছে। আমাদের এই যে সমর্থন, আভ্যন্তরীণ একটা সমর্থন, আন্তর্জাতিক একটা সমর্থন, এই দুই সমর্থনের ভেতর দিয়ে আমরা যদি এই নতুন বাংলাদেশ গড়তে না পারি। এটা আমাদের কর্মের দোষ ছাড়া আর কি বলবো। আমরা এই সুযোগ ছাড়তে চাই না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আন্তর্জাতিক মহলেও আমাদের জিজ্ঞেস করে তোমাদের অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা সাহায্য করতে পারি কি না। সংস্কারের ব্যাপারে আমরা সাহায্য করবো, তোমাদের কি দরকার। আমাদের সংস্কারটা দরকার। তা না হলে এই যে পরিবর্তন এটা টিকিয়ে রাখা যাবে না। আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন, সহযোগিতা এবং শুভেচ্ছা এটা আমাদের জন্য একটা মস্তবড় সম্পদ। এখন যে খেলা চলছে, ঠিক মতো জিতলেও সন্দেহ করে। বলে কিছু একটা কলকাঠি নেড়ে করেছে। এই কলকাঠি নাড়ার বিষয়টি আমাদের মনের ভেতর গেঁথে গেছে। কলকাঠি ছাড়া যে দেশ একটা নিয়মে চলতে পারে সেটা আমরা ভুলে গেছি।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথা বলেন, দেশীয় সমর্থনের কথা বলেন- এটা বলতে গেলে মনটা বড় হয়ে যায়। এছাড়া জাতিসংঘের সমর্থন। আপনারা চিন্তা করেছেন? যে রিপোর্টটা প্রকাশিত হলো। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের একটি প্রতিবেদনে সারা পৃথিবী বদলে গেছে। আর কত সমর্থন চাই আমরা। একেবারে অক্ষরে অক্ষরে বলে দিয়েছে কোথায় কীভাবে মেরেছে, এর থেকে বের হওয়ার তো কারো উপায় নেই। বাংলাদেশকে ঘিরে যে অপপ্রচার চলছিল, এই এক প্রতিবেদন সব সমাপ্ত। বলতে পারবে কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হবে না। আরও অন্যান্য যে-সব প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাদের প্রতিবেদনে অত্যন্ত জোরালোভাবে তাদের অপরাধের কথা উঠে এসেছে।
তিনি বলেন, আমরা সেদিন আয়নাঘরে গেলাম- মানুষ কত নির্মম হতে পারে, বীভৎস দৃশ্যের সৃষ্টি করতে পারে, নৃশংস হতে পারে, এর চেয়ে বড় নমুনা বোধ হয় পাওয়া যাবে না। আমাদের শুধু দেখতে কষ্ট লেগেছে, যারা বছরের পর বছর সেখানে থেকেছে। তাদের কথা চিন্তা করেন। তাদের প্রতিটি বর্ণনা, তাদের অভিজ্ঞতা গুম তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, নতুন বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠন হবে সেটার ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। সেটার ব্যাপারে আইনকানুন সবার জানা থাকবে, এটা নড়চড় করার উপায় কারো থাকবে না। আইনকানুন বানানোর পরে সেটা নড়চড় করার সুযোগ থাকবে না। সে জন্যই এত বড় কমিশন করতে হয়েছে। আজকে আমাদের সেই দ্বিতীয় পর্ব শুরু। আপনারাই এই দ্বিতীয় পর্বের স্রষ্টা, আপনাদের সহযোগিতা করার জন্য আমরা নিয়োজিত থাকবো।