নিজস্ব প্রতিবেদক:
রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার জেলেপল্লি হিসেবে পরিচিত মাঝিপাড়ায় রোববার রাতের তাণ্ডবের পর চারদিকে এখন শুধু ধ্বংসচিহ্ন। হামলার পর সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে ভর করে আছে ভয়-আতঙ্ক। ফেসবুকে এক কিশোরের ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগ তুলে গত রোববার সন্ধ্যার পর হামলা চালানো হয়। ১৮টি ঘর ও দুটি মন্দিরে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি ৪৮টি বাড়িতে ভাঙচুর চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় ৬৬ পরিবারের নগদ টাকা, গবাদি পশু, স্বর্ণালংকারসহ দামি জিনিস লুট করা হয়। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লেও পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। কুমিল্লা, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ, নোয়াখালীর চৌমুহনী, ফেনীসহ বিভিন্ন এলাকায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের অপচেষ্টার পর এবার কলঙ্কিত হলো উত্তরের জনপদ রংপুরের পীরগঞ্জ। সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবলে ক্ষত হলো ওই এলাকার নিরীহ জেলে পরিবার।
পীরগঞ্জের রামনাথপুর ইউনিয়নের বড় করিমপুর কসবা গ্রামের মাঝিপাড়ার দুটি অংশ- উত্তর ও দক্ষিণ। রোববার রাত ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত উত্তর অংশে তাণ্ডব চলে। প্রায় সাত ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। হামলাকারীদের হটাতে পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। হামলার ঘটনায় রাতেই অভিযান চালিয়ে ৪২ জনকে আটক করে পুলিশ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল সোমবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, পীরগঞ্জে হামলা-লুটপাটে জড়িতদের তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যার যা প্রয়োজন সব দেওয়া হবে। খুব শিগগির তাদের বাড়িঘর করে দেওয়া হবে।
হামলার ঘটনায় রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান, সদ্য বিদায়ী পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিরোদা রানী রায়। এছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পৌর মেয়র তাজিমুল ইসলাম শামীমসহ উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে র্যাব, বিজিবিসহ অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
রামনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান ছাদেকুল ইসলাম বিএসসি জানান, খবর পেয়ে সন্ধ্যার পরপরই ঘটনাস্থলে যান তিনি। সে সময় একজনের বাড়ির পাশে খড়ের স্তূপে আগুন জ্বলছিল। কয়েকশ মানুষও তিনি দেখতে পান। তারা ‘ধর্ম অবমাননার’ অভিযোগ তুলে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। তিনি আরও জানান, ঘটনাস্থলে ওসি সরেস চন্দ্রসহ পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত হন। ওসিসহ তিনি মাঝিপাড়ার দক্ষিণ অংশে লোকজনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন। ‘অভিযুক্ত’কে বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতিও দেন। তবে ধীরে ধীরে লোকজন আরও বাড়তে থাকে। তারা রাত সাড়ে ৮টার দিকে মাঝিপাড়ার উত্তর অংশে আগুন দেখতে পান এবং ভাঙচুরের শব্দ ও মানুষের কান্নার আওয়াজও পাওয়া যায়। দক্ষিণ অংশে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত রাখা হলেও কয়েক হাজার মানুষ উত্তর অংশের বাড়িঘরে হামলা শুরু করে।
গতকাল সকালে রংপুর বিভাগীয় কমিশনার আবদুল ওয়াহাব ভূঞা, রেঞ্জ ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য, বিজিবি উত্তর-পশ্চিম রিজিওনের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ইয়াছির, ৫১ বিজিবির অধিনায়ক ইসহাক আহম্মেদ, পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক সুধীর চন্দ্র রায়সহ অনেকে ঘটনাস্থলে আসেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে রান্না করা খাবার দেওয়া হয়। উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রতিটি পরিবারকে চাল, ডাল, চিনি, লবণসহ শুকনো খাবারের প্যাকেট, কম্বল, লুঙ্গি ও শাড়ি বিতরণ করা হয়। ইতোমধ্যে ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে বরাদ্দ হয়েছে ১০০ বান্ডেল টিন।
রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্য ও সাংবাদিকদের জানান, সর্বোচ্চ আইনানুগ ব্যবস্থার পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি পুষিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে সরকার। তিনি আরও বলেন, যারা এ নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছে. তারা সুযোগ সন্ধানী। এ ঘটনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করছি।
ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, আমরা সামনে-পেছনে, মদদদাতা, উস্কানিদাতাসহ প্রত্যেককে খুঁজে বের করব। অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে। হামলার ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে কোনো মামলা না করার বিষয়ে তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্তরা যদি মামলা না করে তাহলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগের বিষয়ে ডিআইজি বলেন, বিষয়টি শোনামাত্রই পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তার বাড়ি ঘিরে নিরাপত্তা দেওয়াসহ পরিস্থিতি শান্ত করেছে।
জেলা প্রশাসক আসিব আহসান জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের আরও সহায়তা দেওয়া হবে। হামলায় জড়িত প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুন দেওয়ার ঘটনাটি সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে বলে আমরা মনে করছি। যারা এ ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা মানবতাবিরোধী। তাদের কোনো দল, মত, দর্শন নেই।
গতকাল দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের সমবেদনা জানায়। পরে ঘটনাস্থলের কাছে বটেরহাট বাজারে প্রতিবাদ সভা হয়। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ আহাম্মেদ, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম রাজু প্রমুখ বক্তব্য দেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ৩০টি পরিবারকে ২ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।
গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ সংযোগ মেরামত করছেন পল্লী বিদ্যুতের কর্মীরা। বিভিন্ন গ্রাম থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের স্বজনরা সমবেদনা জানাতে এসেছেন। এছাড়াও সেখনে শত শত উৎসুক মানুষ ছিল।
ক্ষতিগ্রস্ত সুপদ, রুপালি, সূর্য ও সুনীল ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, চারদিক থেকে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালানো হয়। এ সময় তারা আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। ধানক্ষেত ও জঙ্গলে আশ্রয় নেন। ফলে সবকিছু নীরবে লুট করে হামলাকারীরা।
মাঝিপাড়ায় বসবাস করা প্রায় সবাই মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এখানকার আরেক বাসিন্দা দেবেন্দ্রনাথ বলেন, ‘মাছ বেচি আইত (রাত) ১০টায় বাড়িত আসি দেকি ঘরোত দাউ দাউ করি আগুন জলোছে। হামরা বাড়ির ছইল-ব্যাটা ও বেটি ছইলেরা সবাই মিলি ধানবাড়ির (ধানক্ষেতে) আইলোত নুকিয়া আছিনু (লুকিয়ে ছিলাম)। গোয়াল ঘরে ২টা গরু আছিলো। সেগুলা পুড়ি ছাই হয়া গেইছে। একন কি হবি মোর, বাবা!’
ক্ষতিগ্রস্ত দেমবর ও সুপদি জানান, চার ছেলের সাজানো গোছানো সংসার ধূলিসাৎ হয়েছে। একটি ঘর ও গোয়াল ঘরে আগুন দিয়েছে হামলাকারীরা। এতে একটি অটো ভ্যান ও দুটি গরু পুড়ে মারা গেছে। একটি অটো ভ্যান তারা নিয়ে গেছে। ঘরের টিভি, স্বর্ণালংকারসহ সব দামি জিনিস লুট করা হয়েছে। ভয়ে বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
পূজা উদযাপন পরিষদের জেলা সভাপতি ধীমান চন্দ্র, সম্পাদক অজয় প্রসাদ বামন, উপজেলা সভাপতি অধীর চন্দ্র জানান, দুর্গাপূজার সময়ও মন্দিরে ঝামেলা করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সবাই ঘটনার সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত বলে অভিযোগ করেন এবং তারা আতোয়ার, রাশেদ, আবু, মশিয়ারসহ অনেককে চিনতে পেরেছেন বলে দাবি করেন। এ ব্যাপারে সহকারী পুলিশ সুপার (ডি-সার্কেল) কামরুজ্জামান বলেন, হামলায় জড়িত সবাইকে আটকের চেষ্টা চলছে।
রংপুরে প্রতিবাদ :দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলার প্রতিবাদে রংপুর নগরীতে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। গতকাল সকালে রংপুর প্রেস ক্লাবের সামনে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘের উদ্যোগে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এ সময় পীরগঞ্জে হামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়াসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান বক্তারা।
গতকাল বিকেলে পীরগঞ্জ সদরে উপজেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এর আগে রোববার রাতে জেলা ছাত্রলীগ নগরীর শাপলা চত্বর এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন :পীরগঞ্জের ঘটনায় গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, সেখানে কোনো জীবনহানি হয়নি, তবে সম্পদহানি হয়েছে, বাড়িঘর পুড়েছে। এ ঘটনায় এলাকাবাসীর সহায়তায় ৪৫ জনকে ধরেছি এবং আরও কয়েকজনকে ধরার জন্য চেষ্টা চলছে। পীরগঞ্জে যা ঘটেছে, তাকে আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ঘটনার সূত্রপাত এক কিশোরের ফেসবুকে একটা পোস্ট নিয়ে। ইচ্ছায় দিক বা অনিচ্ছায় বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হোক, স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসন এ ঘটনা আঁচ করে ছেলেটি যেখানে থাকত, সেখানে অভিযান চালায়; তবে ছেলেটিকে পাওয়া যায়নি।’
ওই গ্রামের নিরাপত্তা দিতে সেখানে পুলিশ মোতায়েন ছিল জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, যারা অগ্নিসংযোগ করেছে, তারা দুষ্কৃতকারী। মন্ত্রী জানান, তার কাছে যে তথ্য এসেছে, সেখানে ২৫টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ হয়েছে। দুস্কৃতকারীরা বাড়িঘর লুট করেছে। ৯০ শতাংশের বেশি বাড়িঘর লুটপাট এবং ভাঙচুর করা হয়েছে।
পুলিশ পৌঁছানোর আগেই সেখানে ঘটনা ঘটানো হয়েছে মন্তব্য করে আসাদুজ্জামান খান বলেন, রাতেই অতিরিক্ত পুলিশ, এপিবিএন, র্যাব আর বিজিবি সেখানে গেছে। আমাদের নিরাপত্তার যত ধরনের ব্যবস্থা, সেটি আমরা গ্রহণ করেছি। কিন্তু এ ঘটনাটা আকস্মিকভাবেই দুস্কৃতকারীরা ঘটিয়ে ফেলেছে।
বিএসডি/আইপি