বর্তমান সময় প্রতিবেদন:
রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায়ই সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। হত্যা, গুম, খুন ও অপহরণ করা হচ্ছে তাদের। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ১০ বছরে এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন ৩০ সাংবাদিক। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচার হওয়ার নজির খুব কমই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাংবাদিক হত্যার বিচার ঝুলে যাচ্ছে দীর্ঘসূত্রতায়। শুধু গত এক দশকেই নয়, তার আগের হত্যাকাণ্ডগুলোরও বিচারের নজির মিলছে কম।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। এ সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার ঘোষণা দেন। কিন্তু এক দশক পেরিয়ে আজও শুরু হয়নি ওই হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ। এরই মধ্যে ৮৬ বার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ।
চুয়াডাঙ্গায় সাংবাদিক সদরুল আলম নিপুল ২০১৪ সালের ২১ মে খুন হয়েছিলেন। চুয়াডাঙ্গা থেকে প্রকাশিত দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকার এ সাংবাদিককে হত্যার পর ১০ টুকরা করা হয়। সদর উপজেলার মোমিনপুর রেলস্টেশন থেকে লাশের টুকরা ও তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। কিন্তু এখনো এর বিচার হয়নি। নিপুলের স্ত্রী নিলুফা ইয়াসমিন বলেন, মামলা চালানোর মতো আর্থিক অবস্থা আমার নেই। আমার মেয়ে নিয়েই আমি চলতে পারি না। চার্জশিট দেওয়ার পর কয়েকদিন মামলাটা চলেছিল। এখন মামলা স্থগিত হয়ে আছে। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই। কিন্তু মামলা চালানোর মতো টাকা না থাকায় বিচার কবে পাব জানি না।
২০১২ সালের ১৫ জুন যশোরের দৈনিক গ্রামের কাগজের সাংবাদিক জামাল উদ্দীন হত্যা, ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বিজয় টেলিভিশনের সাভারের ধামরাই প্রতিনিধি জুলহাস হত্যাসহ অধিকাংশ ঘটনার বিচার এখনো হয়নি। সাংবাদিক জামাল হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম বলেন, মামলার তদন্ত প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করে তখন আমরা চার্জশিট দিয়ে এসেছিলাম। এখন আদালতের বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই।
২০০০ সালে যশোরে জনকণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি সামসুর রহমান কেবল হত্যা, ২০০১ সালে খুলনার দৈনিক অনির্বাণের সাংবাদিক এসএম নহর আলী হত্যা, ২০০২ সালে খুলনার দৈনিক পূর্বাঞ্চলের স্টাফ রিপোর্টার হারুনার রশীদ খোকন হত্যার বিচার মেলেনি আজও। ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেস ক্লাবের সামনে বোমা হামলায় একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক মানিক সাহাকে হত্যার মামলায় ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর রায় ঘোষণা হলেও সেই সাজা নিয়ে অসন্তোষ থেকে গেছে স্বজন-সহকর্মীদের।
সাংবাদিক সামসুর রহমান কেবলের ছোট ভাই সাজেদুর রহমান বকুল বলেন, ১৬ জনের নামে পুলিশ চার্জশিট দিয়েছিল। তারপর বাদীকে না জানিয়ে মামলা যশোর থেকে খুলনায় স্থানান্তর করা হয়। চার্জশিটে দেওয়া ১৬ আসামির নামের মধ্যে মামলার পলাতক আসামি দুজনের বাড়ি খুলনায়। ফলে যশোর থেকে খুলনা গিয়ে মামলা চালানো আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। মামলাটি যশোরে স্থানান্তরের জন্য ২০০৫ সালে হাইকোর্টে রিটও করা হয়। তারপর থেকে এখনো এ মামলার কার্যক্রম স্থগিত। ২২ বছর ধরে একটা মামলার বিচার হয়নি। আমরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না। নির্যাতন-নিপীড়নের কোনো বিচার হয় না। আজ পর্যন্ত প্রায় তিন ডজনের বেশি সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন শত শত। কোনো সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচার হওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। সাগর-রুনী হত্যার বিচারে সময় নেওয়া হচ্ছে। সাংবাদিকতা খুব ঝুঁকিপূর্ণ পেশা এটা ঠিক আছে। কিন্তু খুন হয়ে যাবে, নির্যাতিত হবে, বিচার হবে না, এটা কোনো স্বাভাবিক পরিবেশ নয়।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম হাসিব বলেন, ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয় সাংবাদিকদের। ফলে হামলা, নির্যাতন, লাঞ্ছনা, হত্যাসহ নানা ধরনের হুমকির শিকার হন তারা। এসব থেকে সুরক্ষার জন্য আইনি সহায়তাটাই বেশি দরকার। বিচারে দীর্ঘসূত্রতা থাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি ঘটনা অনুযায়ী দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে সাংবাদিক হত্যা কিংবা তাদের ওপর হামলা-মামলা ও হুমকি এসব অনেকটাই কমে আসবে।
হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ বলেন, মামলার আসামিপক্ষের লোকজন বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সময় নেন যাতে বিচারটা না হয়। এক্ষেত্রে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা যদি উদ্যোগ নেন তাহলে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারগুলো আরও দ্রুত পাওয়া সম্ভব।
বিএসডি/ এলএল