জবি প্রতিনিধি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে ঘটনাটি ঘটেছিলো, যে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছিলো, সেটি কোনো মতেই কোনো ব্যক্তিকে বা কোনো রাষ্ট্রপতিকে হত্যা নয়। এটি সম্পূর্ণ রূপে ছিলো একটি প্রতিবিপ্লব। কারণ যে ঘটনার মধ্য দিয়ে একটি জাতির সংবিধান বদলে যায়, ঐ ঘটনাকে কখনোই একটি হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করা যায় না।
রবিবার বিকেলে ১৫ আগষ্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীলদলের আয়োজনে “বঙ্গবন্ধু পরবর্তী বাংলাদেশ” শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনার এসব মন্তব্য করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক এবং নিউজবাংলার সম্পাদক স্বদেশ রায়।
ওয়েবিনারে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে তিনি বলেন, প্রতিবিপ্লবীরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে আমাদের সংবিধানে যে পরিবর্তন গুলো এনেছিলো, যার ভেতর দিয়ে তারা প্রতিবিপ্লবটিকে একেবারে সাংবিধানিকভাবে বাস্তবায়িত করেছিলো।
স্বদেশ রায় আরো বলেন, একটি দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনাই হচ্ছে সংবিধানের মূল সুর এবং তার মূল বিষয়। আমাদের এই প্রস্তাবনায় বলা ছিলো, মার্চ মাসের ২৬ তারিখে জাতীয় মুক্তির জন্য ‘ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে’। কিন্তু আমরা যে রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছি, ‘৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ঐ জায়গাটা পরিবর্তন করে বলা হয় ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে। এই সংগ্রাম কথাটি যুদ্ধ কথাটি কেন আনা হলো। কেননা শুধুমাত্র নয় মাসের যুদ্ধটাকে রাখার জন্য। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতি যে ২২ বছর পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম করেছিলো তা বাদ দেয়ার জন্য। এর মধ্য দিয়ে অসহযোগ আন্দোলনকেই শুধু অস্বীকার করা হয় নি, অস্বীকার করা হয়েছে ‘৫২ এর ভাষা আন্দোলনকে এবং শহীদেরকে। অস্বীকার করা হয়েছে ‘৬৬ এর ৬ দফা। এ অস্বীকারের কারণ বাঙালি, বাংলা ভাষা ও জাতীয়তাবাদকে শেষ করে দেয়ার জন্য।
স্বদেশ রায় বলেন, বঙ্গবন্ধু পরবর্তী বাংলাদেশে গত ৪৬ বছরে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সহ অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। তবে আমাদের রাষ্ট্রধর্ম যে ইসলাম করা হলো সেটি এখনও বাতিল করা হয়নি। সংবিধানের ৩৮ এর সেই যে শর্ত ছিলো যে, এই দেশে কোনো ধর্মীয় সংগঠন বা সমিতি করা যাবে না। পরবর্তীতে এই শর্ত পরিবর্তন করা হয়। যার ফলে আজও জামাতে ইসলামি দাপিয়ে রাজনীতি করছে। বঙ্গবন্ধুর ৪৬ তম শাহাদাত বার্ষিকীতে আমাদের এটাই মনে রাখা দরকার যে, বঙ্গবন্ধুর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত যে বাংলাদেশ ছিলো, সেই বাংলাদেশে আমরা এখনও পৌঁছাতে পারিনি। সেজন্য আমাদের আরো দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হবে।
অতিথি হিসেবে ছিলেন ইনস্টিটিউট অফ সোশাল এন্ড কালচারাল স্টাডিজ কলকাতা, ভারত এর পরিচালক অরিন্দম মুখোপাধ্যায়। ওপার বাংলা এ অতিথি বলেন, বাংলাদেশের পিতা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের মানুষের মনেও গভীরভাবে রেখাপাত করে রয়েছ। স্বদেশ রায়ের কথা ধরে তিনি বলেন, প্রতিবিপ্লব যে আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণের পরবর্তীকালে চলছিলো, সেই আন্দোলন কিন্তু আজও বাংলাদেশে প্রবাহমান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে আমরা কীভাবে বাঁচিয়ে রাখবো, এই ধর্ম নিরপেক্ষতা বাঁচিয়ে রাখবো সেটা নিয়ে আমাদের ভাবনা চিন্তা করতে হবে। শত্রুর বিরুদ্ধে, অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়াতে একটিভ হতে হবে। তাহলেই আমরা এই প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে ভাঙতে পারবো।
ওয়েবিনার এ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান বলেন, বঙ্গবন্ধু কি বলেছেন আর কি বলেন নি সেটি আমি অন্য কারো কাছ থেকে নয় আমি নিজেই শুনেছি বঙ্গবন্ধু পরবর্তী বাংলাদেশ শীর্ষক ওয়েবিনারে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার স্মৃতিচারণ করে তিনি ‘৭৫ এর পূর্বে ও এর পরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ রিলিফ নেয় না বরং পার্শবর্তী দুইটিকে রিলিফ দিয়েছে। আক্ষেপ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ২৭ বছর ধরে কারা আমাদের শত্রু আর কারা মিত্র তা আমাদের একটা বা দুটো প্রজন্মকে শেখাতে পারিনি।
এর আগে ওয়েবিনার শুরুর পূর্বে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট শহীদদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন নীলদলের সহসভাপতি ও ওয়েবিনারের আহবায়ক ড. মোঃ ছিদ্দিকুর রহমান।
ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এস এম আনোয়ারা বেগম। বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার বেগম বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার বিভিন্ন স্মৃতিচারণ করে বলেন, বঙ্গবন্ধুর যে বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন, বঙ্গবন্ধুর যে ত্যাগ, জুলুম অত্যাচার, নিপিড়ন, বঙ্গবন্ধুর যে নেতৃত্ব সব কিছুর বিনিময়ে বঙ্গবন্ধু এ বাংলাদেশ দিয়ে গেছেন। ৭১ সালে আমরা যারা যুদ্ধ করেছি তাদের কাছে বঙ্গবন্ধুই ছিলো একমাত্র অনুপ্রেরণা। যুদ্ধকালীন সময়ে আমাদের একটাই ব্রত ছিলো যেকোনো মূল্যেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে। বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে না পারলে বঙ্গবন্ধুকে আমরা পাবো না। আর বঙ্গবন্ধুকে না পেলে আমরা বঙ্গবন্ধুকে পাবো না।
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে আরো ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম এবং সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিপ্রা সরকার।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নীলদলের সভাপতি অধ্যাপক মোঃ আবুল হোসেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেছেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল কাদের ও সমাজকর্ম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বুশরা জামান।
বিএসডি/জবি/মেহেরাবুল/এমএম