নিজস্ব প্রতিবেদক
সদ্য কারামুক্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম স্মৃতিচারণা করে বলেছেন, ২০১৯ সালে আদালত যখন ফাঁসির হুকুম দিলেন তখন থেকেই আমি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। ফাঁসির মঞ্চে উঠে আল্লাহর কাছে হাজির হব। আর এটাই আমার জন্য সহজ পথ। কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই আমি সবার কাছ থেকে কিন্তু বিদায় নিয়েছিলাম। আমার কাছে যার যে আমানত ছিল দিয়েও দিয়েছিলাম।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় খালাস পাওয়ার পর কারামুক্ত হয়ে দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর পর মতবিনিময় সভায় যোগ দিয়ে একথা বলেন তিনি।
মঙ্গলবার (২৭ মে) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ আপিল বেঞ্চ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলামকে খালাসের আদেশ দেন।
কেরানীগঞ্জ কারাগারের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন এ টি এম আজহারুল ইসলাম। আদালতের খালাসের রায়ের অনুলিপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর পর আজ (বুধবার) সকাল ৯টা ৫ মিনিটে কারামুক্ত হন তিনি।
বুধবার (২৮ মে) সকাল সাড়ে ১১টায় রাজধানীর মগবাজারের আল ফালাহ মিলনায়তনে তার মুক্তি উপলক্ষ্যে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে জামায়াতে ইসলামী।
সেখানে তিনি স্মৃতিচারণা করে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দদের উদ্দেশ্যে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ আমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভালো আছি। বয়সে বার্ধক্যে উপনীত হলেও আমি চিন্তায় চেতনা এখনো যুবক।
তিনি আরও বলেন, আমি চিন্তাও করিনি আপনাদের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে কথা বলবো। আমি সেরকম বক্তাও নই দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারবো। আগে জানলে বুঝলে হয়ত বক্তব্য দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি বা নোট নিয়ে আসতাম।
এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, ২০১৯ সালে আদালত যখন ফাঁসির হুকুম দিলেন তখন থেকেই আমি প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম আল্লাহর কাছে হাজির হব। আর এটাই আমার জন্য সহজ পথ। কোনো ধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই আমি সবার কাছ থেকে কিন্তু বিদায় নিয়েছিলাম। আমার কাছে যার যে আমানত ছিল দিয়ে দিয়েছি। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের দিকে যখন করোনার মধ্যেই যেন আল্লাহর করুনা হলো। দেরি হতে হতে ৫/৬ বছর তো কেটে গেল। কনডেম সেলে ছিলাম। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে দুই নম্বর ফাঁসির সেলে ১০ মাস থাকার সময়। এরপর ৪ নম্বর সেলে আনা হয়। সেখানে অনেক রেস্ট্রিকশন থাকলেও ভালোই ছিলাম।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টের সকাল পর্যন্ত আমার ধারণা ছিল যেহেতু আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাসটা আমার জানা, যে ৫-১০-২০ হাজার মানুষ মরলেও তারা ক্ষমতা ছাড়বে না। ৫ আগস্ট সকালের দিকে প্রিজন সেল থেকে আমি তাকিয়ে দেখি যে, শাহবাগ টিএসসির দিকে অনেক লোক। আমি দেখছি ছোট একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে ঘুসি মারতেছে। তখন আমি বলছিলাম এই সরকার আর থাকতে পারবে না। মানুষের মধ্যে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে, সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এরপর তো সবই আপনাদের জানা। আজকে মুক্ত হলাম।
কী কারণে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? এমন প্রশ্ন তুলে আজহারুল ইসলাম বলেন, আমার তো জমি-জমা সম্পত্তি নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। আমি আসলে ইসলামী আন্দোলন করি, এটাই অপরাধ। নিজামী, মুজাহিদ ভাই গ্রেপ্তার হওয়ার পরে আমি দেড় বছর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছি। তখন পর্যন্ত আমি ভাবি নাই যে আমাকেও জেলে যেতে হবে। কিন্তু জেলে যেতে হয়, তবে তারা আটকাতে পারেনি আমি বের হয়ে আসি। এরপর আমাকে আটকানোর জন্য আবারো জেলে পাঠাতে যুদ্ধাপরাধের এই মামলা দেওয়া হয়। তবে ইসলামী আন্দোলনের কর্মী বলেই এই দীর্ঘ সময়ে আমি সমস্যা বোধ করিনি।
আজহারুল ইসলাম বলেন, আমি ইসলামী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত থাকার সময়ে আমি না লেখাপড়া ভালো জানা ছাত্রছিলাম, স্বাস্থ্যও ভালো ছিল না। কিন্তু আমার বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত থাকলে জেল-জুলুম নির্যাতন, ফাঁসি হবেই। এটা নিয়ে তাই কখনো চিন্তা হতো না। আমার যারা সাবেক সহকর্মী কর্মী আছেন তারা সেটা জানেন।
তিনি আরও বলেন, যে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনের জন্য আমাদের নিজামী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান, মোল্লা ভাইদের সরাসরি ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, আরও সিনিয়র যে নেতারা সুচিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলেন, তারা নিশ্চয় শহীদের মর্যাদা পাবেন। তাদের কোনো অপরাধ ছিল না।
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, আমাদের মুক্তির পথ ইসলাম। দুনিয়া কিন্তু ইসলামের পথে ধাবিত হচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন একটা শক্তি। যে জন্য এই আঘাত চলতেই থাকবে। তবে সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এগিয়ে যাবে।
গত ১৩/১৪ বছরে এতো এতো জেল জুলুম বেআইনি ঘোষণা করেও জামায়াতের অগ্রযাত্রাকে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে? সম্ভব হয়নি। আমাকে গ্রেপ্তারের পর কেন্দ্রীয় অফিস পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিবাদী কণ্ঠ উচ্চারিত হয়েছে। নেতাকর্মী বেড়েছে। এই সময় যারা ইসলামী আন্দোলনে যুক্ত হন তারা সাহসী, কিন্তু কখনো ভীতু হন না।
ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে বাতিলের কখনো আপস হতে পারে না উল্লেখ করে আজহারুল ইসলাম বলেন, আমাদের নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলবে, কিন্তু সেই কথার সঙ্গে আপস করা যাবে না। আমি ইসলাম ছাড়া ক্ষমতায় যেতে চাই না। জামায়াত অবশ্যই ক্ষমতায় যেতে চায় কিন্তু ইসলাম ছাড়া নয়। ইসলামকে নিয়েই ক্ষমতায় যাওয়ার কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
তিনি স্মরণ করে দিয়ে বলেন, যারা দুনিয়ার জীবনের চাইতে আখেরাতের জীবনকে বেশি প্রাধান্য দেয় তারাই সত্যিকারের ইসলামী আন্দোলনের যোগ্য। তারাই আসল মুজাহিদ। দুনিয়াবি জীবনকে ত্যাগ করতে বলা হয়নি, দুনিয়া আমরা ভোগ করবো। কিন্তু দুনিয়া যেন ইসলামী আন্দোলনে বাধা সৃষ্টি না করে। এটার নামই ইসলামী আন্দোলন। এরকম মানুষ যতো বেশি তৈরি করতে পারবো, ততো বেশি ইসলামী আন্দোলন অগ্রসর হবে।
আল্লাহ বলেছেন, যারা দুনিয়ার জন্য বেশি চায় তাকে দুনিয়ায় বেশি দিই, যারা আখেরাতের জন্য বেশি চায় তাদের আখেরাতের জন্যই বেশি দিই। আমাদের দুনিয়া ও আখেরাত উভয়ক্ষেত্রেই কল্যাণ কামনা করতে হবে। এটাই আল্লাহর নির্দেশ।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন- নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান ও সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, সাবেক এমপি ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, মাওলানা মোয়ায্যম হোসাইন হেলাল, অ্যাড. এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য আবদুর রব, সাইফুল আলম খান মিলন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া সেক্রেটারি অধ্যক্ষ শাহাবুদ্দিন, জনাব মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আমির সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও লইয়ার্স কাউন্সিলের সভাপতি অ্যাড. জসিমউদ্দীন সরকার, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, ঢাকা মহানগর উত্তরের সেক্রেটারি ডা. রেজাইল করিমসহ অন্যান্য নেতারা।