নিজস্ব প্রতিবেদক:
৩১ হাজার ওয়ারেন্টের আসামীকে গ্রেফতারে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে জিআর (জেনারেল রেজিস্ট্রার) মামলার ১৭ হাজার ৮৩০ এবং সিআর (কোর্ট রেজিস্ট্রার) মামলার ওয়ারেন্ট আট হাজার ৯২২টি। এছাড়া ১০ মাসে আদালত থেকে ডিএমপির কাছে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা এসেছে আরো চার হাজার ২৪৬টি। অভিযোগ রয়েছে এসব আসামীদের কাছ থেকে অনৈতিক সুযোগ পাওয়ায় তাদের খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ।
জানতে চাইলে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, ওয়ারেন্ট বা গ্রেপ্তারী পরোয়ানা তামিল করা একটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিদিন যে পরিমাণ ওয়ারেন্ট তামিল করা হয়, তার চেয়ে তিনগুন নতুন ওয়ারেন্ট আসে। এ কারণে, ডিএমপি ৫০টি থানায় বিপুল পরিমাণ ওয়ারেন্ট পেন্ডিং আছে। এসব ওয়ারেন্ট কীভাবে দ্রুত তামিল করা যায়, সে বিষয়ে পরবর্তী ক্রাইম কনফারেন্স সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের তাগিদ দেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বরেন, পরোয়ানাপ্রাপ্ত কোনো আসামির সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের যোগসাজসের প্রমাণ পাওয়া গেলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে ঝুলে আছে প্রায় ৩১ হাজার গ্রেপ্তারী পরোয়ানা। ডিএমপি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর পর্যন্ত ঝুলে থাকা গ্রেপ্তারী পরোয়ানার সংখ্যা ২৬ হাজার ৭৫২টি। এর মধ্যে জিআর (জেনারেল রেজিস্ট্রার) মামলার পরোয়ানা ১৭ হাজার ৮৩০ এবং সিআর (কোর্ট রেজিস্ট্রার) মামলার পরোয়ানা আট হাজার ৯২২টি। গত জানুয়ারী থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে আদালত থেকে ডিএমপির কাছে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা এসেছে চার হাজার ২৪৬টি (জিআর এক হাজার ৭১৭ এবং সিআর দুই হাজার ৫২৯)। এই সময়ে পরোয়ানা তামিল করা হয়েছে এক হাজার ২২টি (জিআর ৬১১ এবং সিআর ৪১১)। সব মিলিয়ে পেন্ডিং বা ঝুলে থাকা গ্রেপ্তারী পরোয়ানার সংখ্যা ৩০ হাজার ৯৯৮টি। এর মধ্যে জামিন নিয়েছেন এক হাজার ২১৮ জন। অন্যভাবে নিস্পত্তি হয়েছে ৯৮৬ টি পরোয়না।
বিশ্বস্থ সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি জিআর মামলার গ্রেপ্তারী পরোয়না ঝুলে আছে পুলিশের মিরপুর বিভাগে (ছয় হাজার ৪৮৫টি)। আর সবচেয়ে কম জিআর পরোয়ানা রয়েছে উত্তরা বিভাগে (৭২টি)। সবচেয়ে বেশি সিআর পরোয়ানাও মিরপুর বিভাগে (৩৩৫টি)। আর সবচেয়ে কম সিআর পরোয়ানা তেজগাঁও বিভাগে (১৪২টি)। মোট হিসাবে সবচেয়ে বেশি পরোয়ানা ঝুলে আছে তেজগাঁও বিভাগে। এখানে মোট মূলতবী পরোয়ানার সংখ্যা নয় হাজার ২৮০। আর সবচেয়ে কম মূলতবী পরোয়নার সংখ্যা উত্তরা বিভাগে (৮৯২টি)।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি মামলার বাদী প্রমি ফুডস লিমিটেডের চেয়ারম্যান এনামুল হক খান সহিদ বলেন, উত্তরখান আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল উদ্দিন আমার বিরুদ্ধে মানহানিকর বক্তব্য ফেসবুক ও ইউটিউবে আপলোড করেছেন। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর বিষয়টি আমি অবগত হই। পরে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারী মামলা করি। ফরেনসিক পরীক্ষায় বিষয়টি প্রমাণিত হয়। উত্তরখান থানার এসআই সমিত মজুমদার জব্দ করা আলামত আদালতে উপস্থাপন করেন। আদালত কামাল উদ্দিনকে বারবার নোটিশ দিলেও তিনি আদালতে হাজির হননি। আদালত প্রায় তিন মাস আগে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু পুলিশ তাকে গ্রপ্তার করছে না। অথচ পুলিশের সঙ্গে সভা-সমাবেশ করছেন কামাল উদ্দিন। গ্রেপ্তারী পরোনা মাথায় নিয়েই গত ২৮ নভেম্বর উত্তরখান কাঁচপুরা কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন কামাল উদ্দিন। এসময় পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি এবং ওসিসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তার সামনেই উপস্থিত ছিলেন। অথচ তাকে গ্রেপ্তারের কথা বলা হলে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য বলছেন ‘খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রেপ্তারী পরোয়ানাপ্রাপ্ত আসামি কামাল উদ্দিন বলেন, আমার বিরুদ্ধে হয়রানীমূলকভাবে মামলা হয়ছে। থানা পুলিশ বিধিবহির্ভূতভাবে মামলা রেকর্ড করেছে। আমি দেশের বাইরে ছিলাম। এই সুযোগে আমার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। বিষয়টি ঠিক হয়ে যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক সাংবাদিককেও হয়রানী করা হচ্ছে।
পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি মোরশেদ আলম বলেন, পরোয়ানাভুক্ত আসামিকে গ্রেপ্তারের বিকল্প নেই। উত্তরখান থানার আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে যে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আছে তা আমার জানা ছিল না। এ কারণেই হয়তো তিনি সমাবেশে আমার সামনে প্রকাশ্যে ছিলেন। এখন যেহেতু বিষয়টি জানলাম, তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
জালিয়াতি সংক্রান্ত একটি সিআর মামলার (নম্বর ০৭/২১) বাদী খালেদ ইবনে এরশাদ বলেন, বিআরটিএ সহকারি পরিচালক আলী আহসান মিলন জালিয়াতির মাধ্যমে আমার জমি দখল করে নেন। এ ঘটনায় ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করি। আদালত গত ১৮ অক্টেবর তার নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেন। গ্রেপ্তারী পরোয়ানা মাথায় নিয়েই আলী আহসান মিলন পুলিশের ওয়ারী বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করেছেন। গত ১০ নভেম্বর ওয়ারী বিভাগের (শ্যামপুর জোন) অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কাজী রোমানা নাসরিন আমাকে তার দপ্তরে ডেকে পাঠান। সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখি আসামি আগে থেকেই রোমানা নাসরিনের রুমে বসে আছে। আদালত কর্তৃক গ্রেপ্তারী পরোয়ানাভুক্ত আসামিকে সেখানে দেখে আমি খুবই বিস্মিত হই। পরে মিলনের বিরুদ্ধে থাকা ওয়ারেন্টের কপিসহ সব ধরনের কাগজপত্র এডিসকে রোমানাকে সরবরাহ করি। কিন্তু ওয়ারেন্ট তামিল করা হয়নি। উপরন্তু কালক্ষেপনের মাধ্যমে পুলিশ তাকে জামিনের সুযোগ করে দেন। গত ২৮ নভেম্বর তিনি জামিন পান।
এ বিষয়ে আলী আহসান মিলনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোা হলেও তার মোবাইল নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে ওয়ারী বিভাগের শ্যামপুর জোনের এডিসি কাজী রোমানা নাসরিন বলেন, আসামি মিলন একজন সরকারি কর্মকর্তা। তিনি ডিসি মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। পরে বিষয়টি নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছেন। সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় তাকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়নি। ইতোমধ্যে তিনি জামিন পেয়েছেন কিনা তা এই মুহূর্তে বলতে পারবো না।
প্রতারণা মামলার (সিআর ৫৩৫/১৮) বাদী কেমিকেল ব্যবসায়ী শফিকুল আজম বলেন, কয়েক বছর আগে ব্যবসার কথা বলে মোহাম্মদপুর ইকবাল রোডের বাসিন্দা মো. শাহজাহান আমার কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। পরে প্রতারণার মাধ্যমে তিনি পুরো টাকা আতœসাত করেন। এ নিয়ে ২০১৮ সালের ২৮ জুন আমি আদালতে মামলা করি। গত ২ নভেম্বর আদালত তাকে দোষী ঘোষণা করে আট মাসের জেল দেন। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করেন। মোহাম্মদপুর থানা পুলিশকে পরোয়ানা কার্যকরের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু পুলিশ তা কার্যকর করেনি। আসামি ধরেত পুলিশ কালক্ষেপন করতে থাকে। ২-৩ দিন আগে ওয়ারেন্ট তামিলের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা জানান, আসামি ইতমোধ্যে জামিন পেয়ে গেছেন। আদালতে অর্ধেক টাকা পরিশোধ করেছে। বাকি টাকা পরিশোধের জন্য সময় প্রার্থনা করেছেন।
এ বিষয়ে আসামি মো. শাহজাহান বলেন, সাজা ও ওয়ারেন্ট হওয়ার পর কিছুদিন পলাতক ছিলাম। এ কারণে পুলিশ আমাকে খুঁজে পায়নি। পুলিশ আমাকে যখন গ্রেপ্তার করতে বাড়িতে আসে তার আগেই আমি জামিন পেয়ে যাই। যেহেতু বিষয়টি নিয়ে মামলা চলছে তাই এ নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না।
ওয়ারেন্ট তামিলের দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদপুর থানার এসআই লব চৌহান বলেন, গ্রেপ্তারী পরোয়ানা পাওয়ার পর মো. শাহজাহারকে ধরতে অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু পলাতক থাকায় তাকে ধরতে পারিনি। পরে সে জামিন নিয়ে নেয়।
বিএসডি/এসএফ