নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে জাতীয় পর্যায়ে প্রয়োগ করা হচ্ছে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে আনা কোভিশিল্ড নামে পরিচিত এই ভ্যাকসিনের মজুদ আছে আর মাত্র চার লাখ ৫৩ হাজার ৩৩৭ ডোজ। এই এক সপ্তাহের মধ্যে যদি কোনো স্থান থেকে কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন পাওয়া না যায় তবে খুব দ্রুতই দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম বন্ধ হতে যাচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে চীন থেকে পাচ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন এলেও সেটি পূর্বে নিবন্ধিতদের দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছেন ভ্যাকসিন আসলে খুব দ্রুতই যারা বাদ পড়ছেন তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রয়োগ করা হবে।
বৃহস্পতিবার (২০ মে) সারাদেশে ৫৩ হাজার ৯১৫ ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। সারাদেশে এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করেছেন ৩৯ লাখ ৩০ হাজার ৭৫১ জন। দেশে জাতীয়ভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু পর থেকে প্রথম ডোজের ভ্যাকসিন নিয়েছেন ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৯১২ জন। বাংলাদেশে ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহীদের মাঝে নিবন্ধন করেছেন ৭২ লাখ ৪৮ হাজার ৮২৯ জন।
বৃহস্পতিবার (২০ মে) স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমানের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, এ দিন দেশের রাঙামাটি, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়ায় ভ্যাকসিন দেওয়া হয়নি।
দেশে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তীতে ৮ এপ্রিল থেকে দেশে ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন ধাপে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১ কোটি দুই লাখ চার হাজার ভ্যাকসিন এসে পৌঁছায়।
এখন পর্যন্ত দেশে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৫৮ লাখ ১৯ হাজার ৯১২ জন। যারা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নিয়েছেন তাদের মাঝে এখনও ১৮ লাখ ৮৯ হাজার ১৬১ জনের দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিন নেওয়া বাকি। গাণিতিক হিসেবে ভ্যাকসিনের মজুদ হিসেবে এদের মাঝে চার লাখ ৫৩ হাজার ৩৩৭ জনকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিন পাবে না প্রথম ডোজ পাওয়া ১৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮২৪ জন।
রাজধানীর বিভিন্ন ভ্যাকসিন প্রয়োগ কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন কবে আসবে তেমন কোনো নিশ্চয়তা না থাকায় আপাতত কার্যক্রম স্থিমিত আকারে চালানো হচ্ছে। তবে যদি ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো সম্ভব হবে।
ভ্যাকসিনের পরিসংখ্যান জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ডা. রোবেদ আমিন বলেন, দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন কর্মসূচি চলছে। ইতোমধ্যেই যারা প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছেন সেই সংখ্যার বিপরীতে বর্তমানে এই মুহূর্তে ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫১৪ ডোজ ভ্যাকসিনের ঘাটতি রয়েছে। সময় মতন ভ্যাকসিন না আসলে প্রথম ডোজ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৫১৪ জন দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিন পাবেন না।
ভ্যাকসিন সংকটের কারণে গত ২৬ এপ্রিল থেকে প্রথম ডোজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভ্যাকসিনের পরিবহন থেকে শুরু করে ভ্যাকসিন প্রয়োগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে এক শতাংশ ভ্যাকসিন নষ্ট হতে পারে। আর সেই হিসেবে এখন যা মজুত আছে সেখান থেকে লাখ খানেক ডোজ ভ্যাকসিন কমার আশংকা থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমএনসিঅ্যান্ডএইচ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক বলেন, ‘বর্তমানে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন আছে তা যদি দৈনিক গড়ে ৫০ হাজার ডোজ করে দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে আরও সাত আটদিন চালানো যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে এটার সংখ্যা যদি বাড়ে তবে আরও আগে শেষ হবে। কারণ সবস্থানে কিন্তু ভ্যাকসিন প্রয়োগ একই মাত্রাতে হয় না। সুতরাং রেশনিং করে যতদিন চালানো যায় ততদিন চালানো হবে।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার পেটেন্টের দেওয়া হচ্ছে। এই ভ্যাকসিন আন্তর্জাতিকভাবে ১২ সপ্তাহ থেকে ১৬ সপ্তাহ সময়ে দেওয়া যায় বলে জানানো হয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে যারা প্রথম ডোজ নেওয়ার পরে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার গ্যাপে পড়েছেন বা এই মুহূর্তে পাচ্ছেন না তারা সেই সময়টা অপেক্ষা করার একটা সুযোগ পাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সময়েই যদি আমরা ভ্যাকসিন পেয়ে যাই তবে দেওয়া যাবে। আমরা আসলে সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাই যে সবাই ভ্যাকসিন পাবেই। যখনই আসবে তখনই দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিন পাবে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। উনার সার্বিক তত্ত্বাবধানেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
এ দিকে খুব দ্রুত ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজের ঘাটতি পূরণে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। ভারতের সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে কথা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন। একই সময় তিনি উপহার হিসেবে হলেও ভ্যাকসিন দেওয়ার আহ্বান জানান। এদিকে বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডাকে ভ্যাকসিন দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সরকার।
পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগের দিন ১৩ মে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সবচেয়ে কার্যকর ও পরীক্ষিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন দিয়েই দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ভ্যাকসিন রপ্তানির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, সেই কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায় কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘রাশিয়া ও চীনের ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা চলছে। উপহার হিসেবে চীনের ভ্যাকসিন এসেছে। ভ্যাকসিন পাওয়ার ব্যাপারে আমেরিকার কাছেও অনুরোধ জানানো হয়েছে। কোভ্যাক্সের কাছ থেকেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভ্যাকসিন পাবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিভিন্ন উৎস থেকে এক কোটি ভ্যাকসিন ক্রয়ের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির দেশে ভ্যাকসিন আসতে শুরু করবে। তা ছাড়া দেশেই যাতে ভ্যাকসিন উৎপাদন করা যায়, সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
উল্লেখ্য, দেশে ইতোমধ্যেই চীন থেকে পাঁচ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন এসেছে। ২৫ মে থেকে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, এই ভ্যাকসিনগুলো বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীসহ নার্সিং ইনস্টিটিউট, নার্সিংয়ের শিক্ষার্থীদের প্রয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এছাড়াও পুলিশ বাহিনীর নির্ধারিত সংখ্যক সদস্য ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিরাও পাবেন চীনের সিনোফার্মার ভ্যাকসিন। তবে এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাওয়া ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য আলাদাভাবে সবাইকে ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন সুরক্ষায় নিবন্ধন করতে হবে।
এছাড়াও জুন মাসেই দেশে আসছে ফাইজারের এক লাখ ছয় হাজার ডোজ ভ্যাকসিন। ইতোমধ্যেই দেশে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সিরিঞ্জ চলে এসেছে। সুরক্ষা ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য নিবন্ধিত সাধারণ মানুষরাই ফাইজারের এই ভ্যাকসিন নিতে পারবে। তবে প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী শুধুমাত্র ঢাকাতেই এই ভ্যাকসিন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।