নিজস্ব প্রতিবেদক:
দ্রুত বাড়ছে দেশের জিডিপির আকার। তার চেয়েও দ্রুতগতিতে বড় হচ্ছে সরকারের ঋণ। দেশে ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণ ছিল ৩৪ দশমিক ৬ শতাংশ। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে গত অর্থবছরে (২০২০-২১) এ অনুপাত উন্নীত হয়েছে ৪১ দশমিক ৪ শতাংশে। চলতি অর্থবছরে তা আরো বেড়ে সাড়ে ৪২ শতাংশে দাঁড়াতে পারে বলে ধারণা করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির পূর্বাভাস বলছে, আগামী অর্থবছরে (২০২২-২৩) তা আরো বেড়ে দাঁড়াবে ৪২ দশমিক ৭ শতাংশে।
তবে সরকারের ঘাটতি বাজেটের দ্রুত প্রবৃদ্ধির বিষয়টিতে ইঙ্গিত করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণের হার আইএমএফের পূর্বাভাসকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে ব্যয় নির্বাহে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়িয়েছে সরকার। আর কভিডসহ নানা কারণে বিদেশী উৎস থেকেও সরকারের ঋণ গ্রহণের হার বেড়েছে। এ অবস্থায় ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে জিডিপি ও সরকারের ঋণের অনুপাত ৪৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকতে পারে।
আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকা করে ধরলে বাংলাদেশী মুদ্রায় সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকায়। বিপুল এ ঋণের ৫৮ শতাংশই এসেছে দেশের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে। বাকিটুকু এসেছে বিদেশী উৎস থেকে। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বহুজাতিক বিভিন্ন সংস্থাসহ বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬২ বিলিয়ন ডলারে। বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দেশের জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশে।
রাজস্ব আদায়ে ব্যর্থতাই সরকারের ঋণ-জিডিপি অনুপাত বড় হওয়ার প্রধানতম কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতার কারণে সরকারের ঘাটতি বাজেটের আকার প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ঘাটতি বাজেটের আকার যত বড় হবে সরকারের ঋণও তত বাড়বে। এ মুহূর্তে বাজেটের অন্যতম বড় ব্যয়ের খাত হয়ে উঠেছে ঋণের সুদ পরিশোধ। বিদ্যমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকবে। দিনশেষে জনগণকেই সরকারের এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বর্তমান সময় কে বলেন, রাজস্ব আদায়ে সরকারের ব্যর্থতার কারণেই প্রতি বছর ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ বাড়ছে। বিশ্বের কোনো দেশই এত কম রাজস্ব আয় দিয়ে চলে না। বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি বাড়ানো সম্ভব না হলে অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণ বাড়বেই। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত অন্তত ২০-২২ শতাংশে উন্নীত করতে না পারলে সংকটের কোনো সমাধান হবে না।
তবে সরকারের ঋণ জিডিপি অনুপাত এখনো অনেক বেশি হয়ে যায়নি উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, জিডিপির আকার বিবেচনায় নিলে এখনো সরকারের ঋণ নেয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আহরণের হার না বেড়ে উল্টো প্রতি বছরই কমছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে বাজেটের আকার বড় করে কোনো লাভ হবে না। রাজস্ব আদায় বাড়াতে না পারলে সরকারের ঋণ পরিশোধক্ষমতা কমে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এক দশক আগে ২০১০ সালে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ২১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকায়। ২০২০ সাল শেষে তা বেড়ে হয় ৫ লাখ ২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। গত বছর এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লাখ ১৫ হাজার ৭১৮ কোটি টাকায়। এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে সরকারের নেয়া প্রত্যক্ষ ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। আর ব্যাংকসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে ট্রেজারি বিল-বন্ড বিক্রি করে সরকার ২ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকারও বেশি ঋণ নিয়েছে। সব মিলিয়ে শুধু ২০২১ পঞ্জিকাবর্ষেই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা।
অভ্যন্তরীণ খাতের মতোই সরকারের ঋণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে বিদেশী উৎস থেকে। আইএমএফের তথ্য বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছর শেষে বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণ ছিল ৬ হাজার ২৪৩ কোটি ডলার। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৩০ কোটি ৪১ লাখ ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ১ হাজার ১৬৭ কোটি ২৪ লাখ ডলারের ঋণ। বাংলাদেশের দুই উন্নয়ন-সহযোগী দেশ জাপান ও চীনের কাছ থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে যথাক্রমে ৯০৮ ও ৩৯৮ কোটি ডলার। বাকি ঋণ গ্যারান্টি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ হিসেবে বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বিদেশী উৎস থেকে জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ ঋণ নিয়েছে সরকার।
আয় বাড়াতে না পারলেও প্রতি বছরই বাজেটে ব্যয়ের খাত বাড়াচ্ছে সরকার। এতে বাজেটের আকার বড় হওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভারী হচ্ছে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও এ বাজেটের ২ লাখ ১৪ হাজার ৬৮১ কোটি টাকাই রাখা হয়েছে ঘাটতি বাজেটের খাতায়। দেশের জিডিপির ৬ দশমিক ২ শতাংশই বর্তমানে ঘাটতি বাজেট। বিপুল অংকের এ ঘাটতি বাজেট পূরণের জন্য বিদেশী উৎস থেকে ৯৭ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। বাকি ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ব্যাংকসহ দেশের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
দেশী-বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ বাড়ায় এ বাবদ সরকারের সুদ ব্যয়ও বাড়ছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সুদ পরিশোধ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, যে বাজেটের বড় একটি অংশ সুদ পরিশোধে চলে যায়, সে বাজেট জনগণের জন্য কাঙ্ক্ষিত কল্যাণ নিয়ে আসে না। সরকার রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারছে না। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। নেপাল-ভুটানের মতো দেশেও কর-জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। বাজেট ঘটতির পরিমাণ বাড়ায় সরকারের ঋণ বাড়ছে। তবে সরকারের নেয়া ঋণ কোন খাতে ব্যয় হচ্ছে, সেটি দেখতে হবে। একই সঙ্গে ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় সরকারের ঋণ জনগণের দায় বাড়ানো ছাড়া অন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, এটি ঠিক গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ঋন-জিডিপি অনুপাত বেড়েছে। কিন্তু এ অনুপাত আমাদের সামর্থ্যের মধ্যেই আছে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ কখনো কোনো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। আমাদের ঋণ নেয়ার সক্ষমতা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। আমি মনে করি, উন্নয়ন ও উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের আরো বেশি ঋণ নেয়া উচিত।
তিনি বলেন, এটি ঠিক আমরা রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বাড়াতে পারছি না। তবে এটিও মনে রাখতে হবে, শুধু রাজস্ব আয় দিয়ে আমরা ঋণ পরিশোধ করি না। ঋণ পরিশোধের জন্য অর্থের বিকল্প অনেক উৎস আমাদের রয়েছে। কখনো প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকেও ঋণের অর্থ পরিশোধ করা হবে।
বিএসডি/ এফএস