নিজস্ব প্রতিবেদক
গত এক বছর ধরে চালানো অনুসন্ধানে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ৮০ হাজার নতুন কোম্পানির সন্ধান পেয়েছে; যাদের নাম এতদিন এনবিআরের খাতায় ছিল না। এ সব প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) পর্যন্ত নেননি, দেননি কোনো কর। বছরের পর বছর তারা কর ফাঁকি দিয়ে এসেছে। অথচ একটি প্রতিষ্ঠান চালু করার সময়ে টিআইএন নিয়ে নিয়ম মাফিক কর প্রদান করা বাধ্যতামূলক।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) করপোরেট কমপ্লায়েন্স গঠিত টাস্কফোর্স এ সব করবহির্ভূত কোম্পানির সন্ধান পেয়েছে এবং তাদের টিআইএন নম্বর দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
টাস্কফোর্সের চালানো অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে চট্টগ্রামের একটি শিল্পগোষ্ঠীর পরিচালক ৪৬টি কোম্পানির মালিক। অথচ তিনি কর দিচ্ছেন মাত্র ৪টি কোম্পানি থেকে। বাকি কোম্পানিগুলোর টিআইএন নম্বরই নেই। টাস্কফোর্স উল্লেখিত মালিকের ২০টি কোম্পানিকে টিআইএন নম্বর দিয়েছে। বাকিগুলোকেও করের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে টাস্কফোর্স।
আরও পড়ুন- কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার ঘোষণা প্রতারণা : বিএনপি
অন্যদিকে টাস্কফোর্স আরেকটি কোম্পানির অনুসন্ধান পেয়েছে যারা ৫০ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছে কিন্তু কখনই কর প্রদান করেনি। অনেক কোম্পানি আছে যাদের ঠিকানা একই এবং নেই কোনো টিআইএন নম্বর। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় কারওয়ান বাজারের দুটি ঠিকানা ব্যবহার করে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোম্পানি খোলা হয়েছে। সরেজমিনে গিয়ে এদের অস্তিত্ব পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এক বছর ধরে চালানো এই অনুসন্ধানে যৌথ মূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) ও এনবিআরের মাঠ পর্যায়ের কর সার্কেল থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন কর গোয়েন্দারা। আর তখনই উঠে আসে দুর্নীতির এ ভয়াবহ চিত্র। টাস্কফোর্স সম্পূর্ণ ঘটনাটিকে একটি দেশের জন্য বেদনাদায়ক বলে উল্লেখ করেছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের সিআইসির মহাপরিচালক আলমগীর হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে হাজার হাজার কোম্পানি আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নিয়েও কর ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত যত কোম্পানির খোঁজ পাওয়া গেছে, সবাইকে টিআইএন দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টাস্কফোর্সের কাজ চলমান আছে। আবার যেসব কোম্পানি টিআইএন নিয়েও কর দেয়নি, তাদের রিটার্ন দিতে বাধ্য করা হবে। লোকসান দেখিয়ে যাতে কর ফাঁকি দিতে না পারে, সে জন্য নিরীক্ষা প্রতিবেদন সঠিক কি না, তা যাচাই-বাছাই করা হবে। কারণ কর ফাঁকি দিতে ভুয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনে লোকসান দেখানো হয়।
আরজেএসসির সমীক্ষানুসারে, বাংলাদেশে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৪০০ প্রতিষ্ঠান কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত। এত কোম্পানির নিবন্ধন থাকা সত্ত্বেও করের আওতায় আছে মাত্র ৭৮ হাজার কোম্পানি। অর্থাৎ প্রায় ১ লাখ কোম্পানি বছরের পর বছর কর ফাঁকি দিয়ে আসছে।
এত বছর ধরে কীভাবে কোম্পানিগুলো কর ফাঁকি দিয়ে আসছে জানতে চাইলে দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউনট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) কাউন্সিল মেম্বার মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, এনবিআর ও আরজেএসসির শক্তিশালী নজরদারির অভাবে এত দিন এসব কোম্পানিকে আইন প্রতিপালনে বাধ্য করা যায়নি। এখন এনবিআর নড়েচড়ে বসেছে। তাদের টাস্কফোর্স করের আওতার বাইরে থাকা নতুন নতুন কোম্পানির সন্ধান পাচ্ছে। এসব কোম্পানিকে শুধু টিআইএন দেওয়ার মধ্যে কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। টিআইএন দেওয়ার সময় আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে কি না, নিশ্চিত করতে আইসিএবি ও এনবিআর কাজ করছে।
কোম্পানিগুলোর কর প্রদানে অনীহার তিনটি মূল কারণ উল্লেখ করেছেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাসেম খান। তার মতে করপোরেট করের উচ্চহার, হয়রানির ভয় এবং জটিল করব্যবস্থার কারণেই অনেক কোম্পানি কর দেওয়া থেকে গা বাচিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা করছে।
আবুল কাসেম খান গণমাধ্যমকে বলেন, অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করহার বেশি। কোম্পানির মালিকেরা মনে করেন, একবার কর দিলে হয়রানির সম্মুখীন হতে হবে। ভয়ভীতির কারণে তারা আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নিয়েও করের পথে হাঁটেন না। কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নেওয়ার পরও বহু কোম্পানি নানা কারণে পরিচালনায় যেতে পারে না। আবার পদে পদে অগ্রিম কর, আগাম ভ্যাটসহ নানা ধরনের কর দিতে হয়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব কর কেটে ফেলা হয়, যা বছর শেষে করপোরেট কর দেওয়ায় নিরুৎসাহিত করে।
বিএসডি/এমএম