ইতিহাস-ঐতিহ্য,সংগ্রাম ও সাফল্যে মোড়ানো প্রাচ্যর অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার নয়; বাঙালি জাতির জীবনে যা কিছু বড় বড় অর্জন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে ভাষা আন্দোলন,স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন,গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সহ সবকিছুতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শতবর্ষের এই বিশ্ববিদ্যালয়। বাঙালি জাতিসত্ত্বার মানকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করতে জাতির ক্রান্তিলগে সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দিয়েছে শত বছরের জীবন্ত সাক্ষী এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। দেশ মাটি এবং মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নিভৃতেই কাজ করে চলছে ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাঙ্গনের লক্ষ-লক্ষ শিক্ষার্থীরা। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্ব স্থবির হয়ে যাওয়ায় থমকে দাঁড়িয়েছে সভ্যতার চাকা। অদৃশ্য এক শত্রুর সাথেই চলছে অবিরাম যুদ্ধ। এ যুদ্ধে কেউ জয়ী হয়ে হাসি মুখে ফিরছেন স্বজনদের কাছে কেউবা অবহেলা অযত্ন আর উন্নত সেবা না পেয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন না ফেরার দেশে। এ যুদ্ধে পিছিয়ে নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক মহামারীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, কোভিড- ১৯ ডেডিকেটেড ল্যাব, দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে Negative pressure isolation canopy (NPIC) প্রস্তুতকরণ,(PAPR) ডিজাইন,সেশনজটের ঝুঁকি নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল প্রণীত – ‘loss recovery plan‘ প্রনয়ন, শিক্ষা এবং মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্রকে এগিয়ে নেয়া,দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, বায়ো-রিসার্চ কার্যক্রম,গবেষণার ক্ষেত্রে অবকাঠামোগত উন্নয়ন,খাবারের মান উন্নয়ন,আবাসন সংকট সহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে গল্পে-গল্পে অল্প সময়ে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান। তার মুখোমুখি হয়েছিলেন দৈনিক বর্তমান সময়ের বিশেষ প্রতিনিধি – এম ওয়াহিদ তাওসিফ (মুছা)।
দৈনিক বর্তমান সময়- কেমন আছেন ?
ড. আখতারুজ্জামান- ভালো আছি ।
দৈনিক বর্তমান সময়- বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে করোনা বিষয়ক কোন গবেষণা হয়েছে কিনা?
ড. আখতারুজ্জামান – হ্যা, সেন্টার ফর এডভান্স রিসার্চ ইন সায়েন্সেস কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে সংগঠিত বৈশ্বিক মহামারির ভয়াবহ সময়ে করোনা ভাইরাস নির্ণয়ের জন্য বায়োলজিক্যাল হ্যাজার্ড এনালাইসিস এবং হেলথ রিসার্চ ল্যাবরেটরী শীর্ষক একটি গবেষণা ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। করোনা শনাক্তের জন্য ল্যাবটিতে এ পর্যন্ত ৪০ হাজারের উপরে নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পাশাপাশি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড ল্যাব তৈরি করা হয়েছে গবেষণার জন্য।
বায়মেডিকেল ফিজিক্স এন্ড টেকনোলজি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক ড. সিদ্দিক-ই রব্বানীর তত্ত্বাবধানে একদল গবেষক কোভিড-১৯ এর বিস্তার প্রতিরোধকল্পে সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে Negative pressure isolation canopy (NPIC) প্রস্তুত করা হয়েছে। বিএসএমএমইউ তে এই যন্ত্র প্রদর্শনকালে বিশেষজ্ঞরা একে অত্যান্ত ফলপ্রসু ও সময়োপযোগী বলে অভিহিত করেন।
করোনাক্রান্ত রোগীদের কারনে আইসিইউ ইউনিটে স্ব্যস্থসেবা কর্মীদের ঝুঁকি নিরসনে – pressurized air purifying respirator (PAPR) ডিজাইন তৈরি করা হয়েছে।
দৈনিক বর্তমান সময়- করোনা কালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের কোন ধরনের সহযোগিতা করা হয়েছে কিনা?
ড. আখতারুজ্জামান – সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হতে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা না করা হলেও বিভিন্ন বিভাগের এলামনাই থেকে তাদের পাশে দাঁড়ানো হয়েছে।
দৈনিক বর্তমান সময় – বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার বিষয়টি কোন পর্যায়ে?
ড. আখতারুজ্জামান – পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে এবং টিকা কার্যক্রম চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিওিতে টিকা দেয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশোনা আছে এবং সেই মোতাবেক কাজ চলছে।
দৈনিক বর্তমান সময়- মহামারি করোনার কারনে পিছিয়ে পড়ছে গোটা শিক্ষা কার্যক্রম। সূচনা হচ্ছে সেশনজট সহ নানামুখী সমস্যার। সেশনজট নিরসনে বিশেষ কোন পদক্ষেপ নিয়েছেন কি?
ড. আখতারুজ্জামান – কোভিড ১৯ উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হলেও অনলাইন ও অফলাইনের সমন্বয় আনার মাধ্যমে যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখা হয়। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস করে এবং অনলাইনে বা স্ব-শরীরে বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহন করে দীর্ঘ মেয়াদী সেশনজট রুখতে পারে। শিক্ষার্থীদের সেশনজটের ঝুঁকি নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল প্রণীত – ‘loss recovery plan’ প্রনয়ন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার সামগ্রিক ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনতে লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২০২০ সালে গঠিত একটি কমিটি কাজ করে যাচ্ছে।
দৈনিক বর্তমান সময়- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মৌলিক গবেষণা কতটা এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে?
ড. আখতারুজ্জামান – বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে আমাদের মূল টার্গেট হলো মৌলিক গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ। এছাড়া নতুন কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। গবেষণার ক্ষেত্র ও পরিধি ক্রমান্বয়ে সম্প্র্সারিত হচ্ছে। শতবর্ষে এসে এটি আমাদের মৌলিক দর্শন হিসেবে গৃহীত হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও আমরা বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা-পরামর্শে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছে।
শতবর্ষে এসে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে গবেষণার ক্ষেত্রে যে মোমেনটাম তৈরি হয়েছে, সেটা টেকসই রাখাই হবে আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
আমাদের গবেষক, আমাদের বিভাগ, ইনস্টিটিউট, গবেষণা কেন্দ্রগুলো তারা যে গবেষণা প্রকল্প জমা দিয়েছেন, আমাদের যে জার্নালগুলো আছে সেগুলোর হালনাগাদ ও মান উন্নয়ন করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ,এই গতিকে ধরে রাখতে হবে। একে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি আমরা।
দৈনিক বর্তমান সময়- করোনাকালীন সময়ে অনলাইন শিক্ষা ভবিষ্যতে কতটা সাফল্য বয়ে আনবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আখতারুজ্জামান – অনলাইন শিক্ষা হলো মন্দের ভালো। শিক্ষা কার্যক্রমকে সক্রিয় রাখা। যাতে কোন শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে না থাকে।
দৈনিক বর্তমান সময় – প্রাচ্যর অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আগামী দিনে কোথায় দেখতে চান?
ড. আখতারুজ্জামান – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীতের মতো ভবিষ্যতেও দেশ ও জাতি গঠনে নেতৃত্ব দিয়ে যাবে। আমাদের জাতীয় জীবনে দুটি রূপকল্প আছে। একটি হলো ২০৪১ ঘিরে; আরেকটি ২১০০ সাল ঘিরে; ডেল্টা প্ল্যান।এ দুই পরিকল্পনা বাস্তবায়নেও কাজ করে যাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের পথে এগিয়ে নেবে দেশকে।পরবর্তী একশো বছরের জন্য প্রস্তুত করতে হবে এই অনুভুতির নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ।
দৈনিক বর্তমান সময়- আমাদের সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ।
ড. আখতারুজ্জামান – আপনাকেও ধন্যবাদ। দৈনিক বর্তমান সময়ের জন্য শুভকামনা।
বিএসডি/এমএম