আন্তর্জাতিক ডেস্ক
মহামারি করোনা ভাইরাসের ভয়াল তাণ্ডবের মাঝেই অনেক আফগান শরণার্থী ভারত ছেড়ে নিজ দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। তবে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন তালিবান যোদ্ধাদের হামলা ব্যাপক হাড়ে বৃদ্ধির আশঙ্কায় সেই শরণার্থীরা আবারও সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে এসেছে।
আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফের বাসিন্দা নাসির খান। ৩০ বছর বয়সী এই যুবক এক সময় আফগান সেনাবাহিনীর জওয়ান পদে দায়িত্তরত ছিলেন। এখন আশ্রয় নিয়েছেন নয়াদিল্লিতে। দীর্ঘ ১৯ দিন তালিবান বাহিনীর হাতে বন্দি থাকার পর বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে মুক্তি পান তিনি। মূলত তারপরই জীবন বাঁচাতে চলে এসেছেন ভারতে। হাতে কোনো ধরনের কাজই নেই। কোনো মতে শুকনো ফলের ব্যবসা করে দিন কাটছে তার। তবু স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে নিজ দেশ আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়ার আর সাহস পাচ্ছেন না তিনি। গেলেই ফের তালিবান যোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়বেন, এই আশঙ্কাই সব সময় তাকে গ্রাস করে খাচ্ছে।
নয়াদিল্লিতে জার্মান মিডিয়া ডয়েচে ভেলেকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় বার বার চোখে পানি চলে আসছিল নাসিরের। বলছিলেন, এখন আমার সবচেয়ে বড় লড়াই ক্ষুধার সঙ্গে। ভারতে এসে আমাদের মতো অনেককেই প্রতি মুহূর্তে সেই লড়াইটাই চালিয়ে যেতে হচ্ছে। কখনও কখনও মনে হয়, মরতেই যদি হয়, দেশের মাটিতে মরি। অন্তত সামান্য সম্মানের সঙ্গে মরতে পারব। কিন্তু তারপরই মনে হয়, দেশে ফেরা মানে, গোটা পরিবারকে তালিবান বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া।
নাসিরের বাবা-মা এখনো মাজার-ই-শরিফে বসবাস করছেন। কখনও ফোনে পাওয়া যায়, কখনও লাইন পাওয়া যায় না। কথা হলে বৃদ্ধা মা আতঙ্কিত কণ্ঠে শোনাতে থাকেন, কীভাবে তালিবান তাদের সব কিছু ঘিরে ফেলেছে। বার বার বাড়িতে এসে নাসিরের খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে। বলতে বলতে নাসিরের মনে পড়ে যায়, কীভাবে রাস্তা থেকে তাকে বাইকে তুলে নিয়েছিল তালিবানের সদস্যরা। সেবার তারা নাসিরকে নিয়ে যায় নিজেদের ডেরায়। সেখানেই ১৯ দিন ধরে তার সঙ্গে চলে অকথ্য নির্যাতন।
তার ভাষায়, তারা আমাকে মেরেই ফেলত। বাবা কয়েকজন পশতুন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করে বিরাট অঙ্কের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়িয়ে এনেছেন। তারপর আর আফগানিস্তানে থাকার সাহস পাইনি।
নাসিরের মতো বহু আফগান শরণার্থীকে নিয়ে এখন ব্যস্ত ভারতে আফগান শরণার্থীদের সংগঠনের প্রেসিডেন্ট আহমেদ জিয়া গনি। গত কয়েক দশক আগে তিনিও তালিবান যোদ্ধাদের হাতে বন্দি ছিলেন। এর কিছু বছর পর তার ছেলেকেও অপহরণ করেছিল তালিবান। যদিও সেই ছেলে এখন আর বেঁচে নেই। ইরান, জার্মানি, রাশিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশে শরণার্থীর জীবন কাটিয়েছেন এই চিকিৎসক। তবে এখন আহমেদের ঠিকানা হয়েছে দিল্লি।
আহমেদ বলেন, প্রাণঘাতী করোনার তাণ্ডব শুরুর পরপরই ভারতে বসবাসকারী বহু আফগান শরণার্থী দেশে ফেরার চেষ্টা করছিলেন। কারণ এখানে তারা কোনো ধরনের স্বাস্থ্য পরিষেবা পাচ্ছিলেন না। তখন শুনেছি অনেকে নাকি চলেও গেছিলেন। কিন্তু আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে অনেকেই ভয়ে ও আতঙ্কে আবারও ফিরে আসতে শুরু করেছেন।
সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় ভয়ের বাতাবরণ দেখা দেয় নিজামুদ্দিনের মুখেও। পেশায় শিক্ষক নিজামুদ্দিন এখন দিল্লির সড়কে আফগানি নান বিক্রি করেন। তালিবান যোদ্ধারা নাকি তার বাবাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেই বাবার আর কোনো সন্ধান মেলেনি। বাড়ির দুই বোনের নাম খাতায় লিখে নিয়ে গিয়েছিল তালিবান নেতারা। ওই সময় তালিবানের নেতা বলেছিলেন, তাদের বিয়ে নাকি তালিবান যোদ্ধাদের সঙ্গেই দিতে হবে। এরপরই দিল্লিতে পালিয়ে আসেন নিজামুদ্দিন। এখন বোনরাও তার সঙ্গেই রয়েছেন।
আরও পড়ুন- পরীমনির সহযোগী রাজও আটক, মাদক উদ্ধার
সত্তর-আশির দশক থেকে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আসতে শুরু করেন আফগান নাগরিকরা। দিল্লিতে এই মুহূর্তে প্রায় ২১ হাজার আফগান শরণার্থী রয়েছেন। করোনার সময় তাদের অনেকেই দেশে ফিরছিলেন বা ফেরার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এখন সেই পরিবারকে ভারতে আনার চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা।
সেই আশির দশকে ভারতে পালিয়ে আসেন ফাহিম। পড়াশোনাও করেছেন দিল্লিতেই। এখন বৈধ কাগজ নিয়ে ভারতে বসবাস করছেন। শহরের মাঝেই একটি রেস্তোরাঁ চালান। কথায় কথায় ফাহিম বলছিলেন, বর্তমানে আফগানিস্তান একটা যুদ্ধের প্রকল্প ভূমিতে পরিণত হয়েছে। আপাতত সেখানে প্রজেক্ট তালিবান চলছে। কেননা বিভিন্ন দেশের যুদ্ধ বাণিজ্য জড়িয়ে আছে তাদের সঙ্গে। তালিবান নেতারা ক্ষমতায় চলে এলে দেশে আবারও একটা নতুন প্রকল্প শুরু হবে। তালিবান বিরোধীদের হাতে সে সময় আবারও অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে। এমনকি তাদের দেওয়া হবে বিপুল পরিমাণ টাকাও।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ফাহিম দাবি করেন, দশকের পর দশক ধরে এভাবেই এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়ে আছে দেশটিতে। এতে সাধারণ আফগান নাগরিকরা ভীষণ বিরক্ত ও হতাশ। এখন তাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
ভারতের দিল্লি শহরের আফগান পাড়া বরাবরই ঝকঝকে। নানান ধরনের ব্যবসায় শোভিত। সড়কে নামলেই দেখা মিলে নানা রঙের মানুষের। সেই আফগান পাড়ায় এখন কান পাতলেই শোনা যায় বিষাদের সুর। থমথমে বড্ড থমথমে। কিন্তু ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলোর সামনে গেলেই কেবল দেখা যায় ভিড়।
বিএসডি/এমএম