জাহিদ রহমান
সভ্যতার বিক্ষিপ্ত বিস্তৃতিতে আমরা রীতিমত পাল্টে যাচ্ছি দিন দিন। কিন্তু সভ্যতার চাদর গায়ে সুশীল ভাবে নিজেকে সমাজে উপস্থাপন করে চললেও আমরা কি সত্যিই সভ্য হতে পারছি? এই প্রশ্নটি কিন্তু থেকেই যায়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক অত্যন্ত পবিত্র। ভালোবাসার এই পবিত্র সম্পর্কেই এক সময় সম্পর্কের পূর্ণতা নিয়ে আসে সন্তান। সম্পর্ক আরও শক্ত বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে যায় সন্তানের মায়ায়।
কিন্তু আজ সভ্যতার অন্তরালে যেন সবারই আত্মকেন্দ্রিক মনোভাব বেড়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন সন্তানের মায়ায় পিতামাতা অনেক কিছু সহ্য করতেন। সন্তানের মাঝে খুঁজে নিতেন নিজেদের অস্তিত্ব। তাই নিজেদের মধ্যে অনেক মনমালিন্য মিটিয়ে নিতেন, ক্ষমা করে দিতেন একে অপরের ত্রুটি, যাতে সন্তানের উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব না আসে।
সময়ের ব্যবধানে এখন সন্তানের দিকে নজর দেয়ার মত সময়ও নেই অনেকের। এখন সন্তানের মাঝে অনেক পিতামাতা নিজেদের অস্তিত্বও খুঁজে পান না। তাইতো সদ্যজাত শিশু সন্তানকে পাওয়া যায় ডাস্টবিনে, ড্রেনে কিংবা কুকুরের মুখে।
পিতা মাতার পরকিয়ার ফলে অবুঝ শিশু হত্যার মত ঘটনা ঘটছে সমাজে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়ায় তারা আলাদা হয়ে যাওয়ায় সন্তানকে চাইল্ডহোমে রেখে আসা হচ্ছে। একবারও ভাবা হচ্ছে না ঘরের ছোট বাচ্চাটির কথা, তার ভবিষ্যতের কথা। এই কি সভ্যতার ফলাফল?
ডিভোর্সের ফলে স্বামী-স্ত্রী নিজেদের উপর যেমন প্রভাব পড়ে, তেমনি পড়ে সন্তানদের উপর। পিতামাতার বিচ্ছেদের ফলে সন্তানের মনে এমনিতেই এক ধরনের অবসাদ তৈরি হয়। পাশাপাশি অতি উৎসাহী আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীরা তাদের সামনে পিতামাতার বিচ্ছেদ নিয়ে আলোচনা বা নানারকম প্রশ্ন করে বিব্রত করে থাকে।
এই বাচ্চাগুলোর শৈশব অন্যদের মতো নয়। এ শিশুরা নিজেদের আবেগ অনুভূতি গুটিয়ে রাখতেই বরং পছন্দ করে। ফলে তাদেরকে পিতামাতা কিংবা শিক্ষকেরা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। স্কুলের শিক্ষকেরাও এ শিশুদের অন্যদের চেয়ে ভিন্ন নজরে দেখে থাকেন। কোন একটা অপরাধে অনেকটা মুখের উপর বলেই ফেলেন পিতামাতা ছাড়া সন্তান এমনই হয়। অথচ এমন নয় যে, সেই ভুলগুলো স্বাভাবিক পরিবারের সন্তানগুলো করেনা। আসলে আমরা মুখেই বলি, সকল শিশু সমান। বাস্তবতা তা নয়।
পিতা মাতার অভাবে শিশু নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, পিতা মাতার নতুন বিয়েও তারা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে পিতা মাতার নতুন করে বিয়ের কারণে, নতুন পরিবারেও তাদের যায়গা হয় না।
শিশুর ভরনপোষণের দায়িত্ব যথাযথভাবে নেয়া না হলে, আর্থিককারণেও শিশুটি অন্যের কাছে ছোট হয়ে থাকে। অনেকটা আশ্রয় নিয়ে বড় হয় নানাবাড়িতে বা অন্যকোন আত্মীয়ের বাড়িতে। ফলে নিজের মানসিক বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব সুন্দরভাবে গড়ে ওঠে না।
বাচ্চা যখন ছোট থাকে তখন সেই শিশুটিকে সবাই আদর করতে চায়, নানা নানীও নিজের সন্তানের মত করেই নাতী পালন করতে চায়। কিন্তু ছোট বাচ্চার গায়ে এক ধরণের আদুরে গন্ধ থাকে, কোলে নিলেই আপন করে নিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু সেই বাচ্চা বড় হলে সেই আদুরে গন্ধটিও থাকেনা, সেই আপন করে নেয়ার ইচ্ছেও থাকেনা।
তখন এই বাচ্চাগুলোও বুঝতে পারে সন্তানের মত আদর আর নিজের সন্তানের কি পার্থক্য। তখন বুঝতে পারে যে, নানা নানীও নিজের মেয়ের নতুন সংসারে যেন এই আগের ঘরের সন্তানের জন্য কোন সমস্যা না হয়, এজন্যই লালন পালন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ছুটি” গল্পের ফটিকের কথা মনে আছে? সেই ফটিকের অবস্থা হয় এই সন্তানগুলোর।
এ ধরণের শিশুরা যেমন অবহেলিত তেমনি আবার কখনো কখনো অতিরিক্ত প্রশ্রয়ও পেয়ে বড় হয়। শিশুর অভিভাবক বা শুভাকাঙ্খীরা ভাবেন, “ইস, বাচ্চাটার পিতামাতা কাছে নেই।” ফলে শিশুর ব্যবহার বা কাজে ভুল থাকলে সংশোধন করেন না। অনেক সময় পিতা মাতার অভাব অনেক বেশি দামী উপহার দিয়ে পূরণ করতে চান। না চাইতেই সব আবদার মিটিয়ে ফেলা হয়। আর অতিরিক্ত প্রশ্রয়ের ফল যে ভালো হয় না, সেটাও কিন্তু নতুন কিছু নয়।
আবার অবহেলিত শিশুদের সংকট আরেক ধরনের। এই শিশুরা পিতামাতার থেকে দূরে থাকার ফলে তারা পিতামাতার যথেষ্ঠ আদর সেভাবে পায় না। তারা ঐ এটেনশন তখন অন্য কারো কাছ থেকে পেতে চাইবে। সেক্ষেত্রে খারাপ মানুষজন তাদেরকে খুব সহজেই আদর স্নেহ ভালোবাসার মায়ায় বশীভূত করে ফেলতে পারে। এতে সে শিশু বড় ধরণের ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। যৌন নিগৃহের স্বীকার থেকে শুরু করে কোন ধরণের উগ্রপন্থী দলে ভিড়ে যেতে পারে খুব সহজেই।
পরিশেষে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা এক দিনে ঘটে না, এর আগে ঘটে থাকে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা। এই অপ্রীতিকর ঘটনাগুলোর সাক্ষী থাকে ঘরের সেই ছোট শিশুটি। দীর্ঘদিন ধরে চলা মানোমালিন্য, শারীরিক নির্যাতন, দাম্পত্য কলহ, কান্নাকাটির মতো অপ্রীতিকর অনেক ঘটনায় শিশুটিকে সামনাসামনি হতে হয়।
বাড়ির ছোট শিশু এসব দেখে বাড়ির সামগ্রিক অবস্থা বুঝতে পারে না, এটা সম্পূর্ণ একটি ভুল ধারণা। সরাসরি পিতা-মাতার কলহ না দেখেও শিশুরা নিজেদের মত করে বুঝে নেয়। আবার অনেক সময় পিতা-মাতার ভেতরে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স শিশুর মনে সাক্ষী রেখে দেয়। যা কিনা দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক ধারণার ভেতর রাখে শিশুদের।
বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সন্তানের উপর। তারা একটা মানসিক টানা-পোড়েনের মধ্যে দিয়ে যায়। বাবা-মায়ের ডিভোর্সের পর সন্তান কার কাছে থাকবে, সে বিষয়েও তাকে প্রভাবিত করা হয়। ফলে পিতামাতার প্রতি একটি বিরূপ ধারণা নিয়ে সন্তান বড় হতে থাকে।
লেখক : ব্যারিস্টার