করোনার প্রকোপ রোধে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা কারখানায় মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করছে। কিন্তু তারা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছে না। শ্রমিকরা দল বেঁধে কারখানায় ঢুকছে, বেরও হচ্ছে দল বেঁধে। কার আগে কে কারখানায় ঢুকবে, বের হওয়ার সময় কার আগে কে বের হবে তা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা চলছে তাদের মধ্যে।
শুধু তাই নয়, শ্রমিকরা কারখানার ভেতরে মাস্ক কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করছে। অথচ বাইরে বের হয়েই আর সামাজিক দূরত্ব মানছে না। পরছে না মাস্কও। ফলে শ্রমিকদের মধ্যে করোনা ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা বাড়ছে।
শ্রমিকরা বলছেন, গরিবের আবার কিসের করোনা, কষ্টের কাজ করলে করোনা হয় না। তাই এত নিয়ম করে চলতে পারব না। তারা বলেন, স্যাররা অফিসের গাড়িতে যাতায়াত করেন। আমরা অফিসে আসি-যাই লোকাল বাসে। সামাজিক দূরত্ব মানমু কেমনে? বাসে উঠতে হয় ধাক্কাধাক্কি করে। নামতেও হয় একই কায়দায়।
শ্রমিকরা সামাজিক দূরত্ব মানছে না বলে স্বীকার করছেন কারখানা মালিকরাও। তারা বলছেন, একজন শ্রমিকেরও যাতে করোনা না হয়, সেজন্য শ্রমিকদের মাস্ক দিচ্ছি। কারখানায় হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রেখেছি। শ্রমিকদের সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার নির্দেশনাও দিয়েছি। কিন্তু অনেকে মানছে না। তারা যাতে করোনা রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করে এজন্য প্রতিদিনই সচেতন করছি।
কলকারখানা পরিদর্শন অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, অধিকাংশ পোশাক কারখানায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে। কিছু কিছু কারখানায় সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার পশ গার্মেন্টস লিমিটেডের শ্রমিকরা কারখানায় ঢোকার সময় সামাজিক দূরত্ব মানছে না। তারা সকাল ৮টার দিকে কারখানায় প্রবেশ করছে দলে দলে। দায়িত্বে থাকা একাধিক ব্যক্তি না জটলা না বেঁধে একজন একজন করে কারখানায় প্রবেশ করতে বলেন। কিন্তু শ্রমিকরা সে কথা কানেই তুলছে না। এসময় অনেক শ্রমিকের মুখে মাস্ক ছিল না।
একই দৃশ্য ছিল লাঞ্চ বিরতির সময়ও। দুপুর ১টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকরা দল বেঁধে বের হতে শুরু করে। বের হয়েই অনেকে মুখের মাস্ক খুলে ফেলে। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জটলা বেঁধে খাবার খেতে গন্তব্যে যেতে দেখা যায় তাদের।
একই দৃশ্য দেখা গেছে নাসা গার্মেন্টসেও। এই কারখানার অনেক শ্রমিক হাতে করে মাস্ক নিয়ে এসেছে, গার্মেন্টসের কাছে এসে সেটি মুখে লাগিয়েছে। কারখানার ভেতরে ঢুকে সাবান দিয়ে হাতমুখও ধুতে দেখা গেছে তাদের। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব মানছে না। এ সময় শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা কারখানায় ঢুকতে বাধা দেয়। তারা ছবিও তুলতে দেয়নি।
মুশফিক নামের এই কারখানার এক কর্মকর্তা বলেন, শ্রমিকরা যাতে করোনা রোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন তার জন্য আয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, সময় কম, তাই তারা তাড়াহুড়ো করে ঢুকছে, সামাজিক দূরত্ব মানছে না। তবে কারখানায় ঢুকলেই প্রথমে তাপমাত্রা মাপা হচ্ছে। এরপর সাবান দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার করে কাজ শুরু করছে। শুধু পশ কিংবা নাসা গার্মেন্টস নয়, অধিকাংশ গার্মেন্টসের অবস্থাই এমন।
বাড্ডা থেকে রামপুরার একটি কারখানায় কাজ করা শ্রমিক হাবিবা মাস্ক না পরেই কাজে যাচ্ছেন। রামপুরা ব্রিজ এলাকায় কথা হয় তার সঙ্গে। মাস্ক না পরার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে ক্ষেপে যান। পরে বলেন, কিসের করোনা কিসের কী? তার সঙ্গে থাকা অপর দুই সহকর্মীকেও মাস্ক ছাড়াই কাজে যেতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের প্রধান মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে কি না দেখভালের জন্য কয়েকটি কমিটি করেছি। কমিটির প্রতিবেদন দেখেছি। বেশির ভাগ কারখানা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে। যেগুলোতে সমস্যা আছে, সেগুলো নিয়ে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
জানতে চাইলে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র শ্রম বিভাগের পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, কারখানাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া আছে। করোনায় এখন পর্যন্ত কোনো গার্মেন্টস কর্মীর মৃত্যু হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের কারখানার ৯০ শতাংশ শ্রমিক হেঁটে আসে। কারখানার ভেতরে তারা মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে। কারখানার বাইরে হয়ত তারা ঠিকমতো নিয়ম মেনে চলে না। কিন্তু কারখানার ভেতরে সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনেই চলছে।
কারখানায় প্রবেশ ও বের হওয়ার পথে কী তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সময় স্বল্পতার কারণে হয়ত একটু তাড়াহুড়ো করে শ্রমিকরা, এটা ঠিক।
ফজলে শামীম এহসান বলেন, স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিচ্ছি। এর মধ্যে প্রধান হলো মাস্ক পরা, কারখানায় সবাই মাস্ক পরে ঢুকছে। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে- সবাইকে হাত ধুয়ে কারখানায় প্রবেশ করতে হচ্ছে। তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব, সেটাও মানা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র নতুন সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, জায়ান্ট গ্রুপের কারখানা শতভাগ নিয়ম মেনে চলছে। আমাদের শ্রমিকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করছে। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর বিজিএমইএ’র কোনো কারখানা যেন স্বাস্থ্যবিধির নিয়মের বাইরে না থাকে সে বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হবে।