কৃষি ডেস্ক,
বাংলাদেশে ১৯৬০ সালের দিকে জাহাজ ভাঙা শিল্পের গোড়াপত্তন হয়। তবে আদতে এ শিল্পটির বিকাশ হয় ৯০-এর দশকে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও আশপাশের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে বিস্তৃত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো দেশের ইস্পাতের চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশের জোগান দেয়। সময়ের সঙ্গে এ শিল্পের আকার যেমন বেড়েছে, তেমনি এর কারণে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে পরিবেশ দূষণের ঘটনাও। সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, জাহাজ ভাঙা শিল্প এলাকা ও এর আশপাশের কৃষিজমিতে নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বিভিন্ন ধরনের ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এসব আবাদি জমিতে উৎপাদিত ফসলের মাধ্যমে ক্ষতিকর ভারী ধাতু প্রবেশ করছে মানুষের শরীরে। যার ফলে ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগের আশঙ্কার কথাও বলছেন গবেষকরা।
সীতাকুণ্ডে জাহাজ ভাঙা শিল্প খাতসংলগ্ন কৃষিজমির অবস্থা জানতে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের দুজন শিক্ষক। ‘হেভি মেটাল কনসেনট্রেশনস অ্যান্ড ইটস ইমপ্যাক্ট অন সয়েল মাইক্রোবায়াল অ্যান্ড এনজাইম অ্যাক্টিভিটিজ ইন এগ্রিকালচারাল ল্যান্ডস অ্যারাউন্ড শিপ ইয়ার্ডস ইন চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় জাহাজ ভাঙা শিল্প খাতের কারণে নির্গত ভারী ধাতুর কী পরিমাণ অংশ স্থানীয় চাষযোগ্য মাটিতে মিশছে ও পরিবেশগত ঝুঁকি তৈরি করছে, তার মূল্যায়ন করা হয়।
এজন্য স্থানীয় সবজি বাগান, সবজির ক্ষেত ও ধানক্ষেতের মতো ১৯টি স্থানের মাটি নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। সংগৃহীত এ নমুনার মধ্যে বেলে-দোআঁশ মাটি, অত্যন্ত ক্ষারযুক্ত থেকে মাঝারি ক্ষারযুক্ত মাটি পাওয়া যায়। যার পিএইচ লেভেল ৪ দশমিক ২৩ থেকে ৫ দশমিক ৮৮। মাটির জৈব পদার্থের সীমা পাওয়া গেছে শূন্য দশমিক ৭৯ থেকে ১ দশমিক ৪৩ পর্যন্ত। এমনকি মাটির নমুনায় পাওয়া ভারী ধাতুর গড় ঘনত্ব নির্ধারিত মানের চেয়ে কয়েকশ গুণ বেশি। কৃষি জমিতে যেসব ভারী ধাতু পাওয়া গেছে তার মধ্যে রয়েছে ক্যাডমিয়াম, লেড, কপার, জিংক, নিকেল ও ক্রোমিয়াম।
কৃষিজমিতে পাওয়া এসব ভারী ধাতুর বেশির ভাগই এসেছে জাহাজ ভাঙা শিল্প খাতের বিভিন্ন সামগ্রী প্রক্রিয়াজাত করার সময়। সেখানকার মাটিতে ক্যাডমিয়ামের ঘনত্ব প্রতি কিলোগ্রামে ১ দশমিক ৭৭ থেকে ৮ দশমিক ১ মিলিগ্রাম। ক্রোমিয়ামের ঘনত্ব প্রতি কিলোগ্রামে ১০২ দশমিক ৭৫ থেকে ২৬২ মিলিগ্রাম। কপারের ঘনত্ব প্রতি কিলোগ্রামে ৯০ দশমিক ৫২ থেকে ৬৬২ দশমিক ৩৩ মিলিগ্রাম। নিকেলের ঘনত্ব প্রতি কিলোগ্রামে ২৬ দশমিক ৬৬ থেকে ২২৭ দশমিক ৪৭ মিলিগ্রাম। সিসার ঘনত্ব প্রতি কিলোগ্রামে ১৪৮ দশমিক ৩৩ থেকে ১ হাজার ৪৮৩ দশমিক ৩৩ মিলিগ্রাম। দস্তার ঘনত্ব প্রতি কিলোগ্রামে ২৭০ দশমিক ৩৭ থেকে ১ হাজার ৪১৬ দশমিক ১৩ মিলিগ্রাম। দেশের কৃষিজমিতে এসব ধাতুর সহনীয় কোনো মাত্রা নির্ধারিত নেই বলেও উল্লেখ করা হয় গবেষণায়। চীন, নেদারল্যান্ডস, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার কৃষি জমিতে মানমাত্রার উল্লেখ করে গবেষকরা দেখিয়েছেন, সীতাকুণ্ডের কৃষিজমিতে এসব ক্ষতিকর ধাতুর উপস্থিতি ৩ থেকে ১৫ গুণ পর্যন্ত বেশি।
এ বিষয়ে গবেষক দলের সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরিন চৌধুরী বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের পুরনো ও বাতিল জাহাজ এখানে ভাঙা হয়। এসব জাহাজ ভাঙতে পরিবেশ রক্ষার জন্য যেসব ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন, সেগুলোর দিকে লক্ষ্য রাখা হয় না। ফলে জাহাজ ভাঙার সময়ই পরিবেশ দূষণের ঘটনা ঘটে। স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে নির্গত কালো তেলসহ অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান সরাসরি স্থানীয় মাটি ও পানিতে মিশে যায়। আবার এসব জাহাজ থেকে লোহা ও সিসার মতো ধাতু সংগ্রহ করার পর বিভিন্ন অনুষঙ্গ বিক্রি করে দেয়া হয়। সেসবের জন্য আলাদা বাজারও গড়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, পরিবেশের ঝুঁকি বিবেচনা না করেই জাহাজের বিভিন্ন ইলেকট্রনিক পণ্য বা ই-ওয়েস্ট খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর। এসব বিষাক্ত উপাদান মাটি ও পানিতে যাচ্ছে। চক্রাকারে তা আবার মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। জাহাজের এসব সামগ্রীতে সিসা, ফাইবার গ্লাস, কার্বন, সিলিকন, পারদসহ নানা ক্ষতিকর ধাতু থাকে। পরিবেশের ঝুঁকি বিবেচনায় না নিয়ে ও কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই জাহাজ ভাঙা শিল্পের উদ্বৃত্ত এসব পণ্যের বাজার পরিচালনা করা হয়। উন্মুক্ত স্থানে এসব সামগ্রী ভাঙা, বেচা-কেনা ও সবশেষে বিভিন্ন আবর্জনার স্তূপ বা পানিতে ফেলার মাধ্যমে কৃষিজমি দূষণের ঘটনা ঘটছে।
জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) জানিয়েছে, চলতি বছরের জুলাইয়ের সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড চালু আছে ৩০ থেকে ৩৫টি। সীতাকুণ্ডের মাদাম বিবির হাট, কুমিরা, ভাটিয়ারী, সোনাইছড়ি, জাহানাবাদ, কদমরসূল, বাঁশবাড়িয়া ও মিরসরাই উপকূলজুড়ে এসব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড গড়ে উঠেছে। ২০০১-০২ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত গত ২০ বছরে চট্টগ্রামের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হয়েছে ৩ হাজার ৩২৯টি। আমদানি করা এ জাহাজগুলো থেকে এখন পর্যন্ত সর্বমোট ৩ কোটি ৭৬ লাখ ৫৭ হাজার ৭৭ টন স্ক্র্যাপ বাংলাদেশে কাটা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিপইয়ার্ডে যেসব জাহাজ কাটা হয় তার অধিকাংশই অয়েল ট্যাংকার। ভাঙার জন্য আনা আমদানি করা জাহাজগুলোতে থাকে কালো তেল ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য। ক্ষতিকর এসব দ্রব্য সহজেই মিশে যাচ্ছে স্থানীয় মাটি ও পানিতে।
পরিবেশের ওপর জাহাজ ভাঙা শিল্পের প্রভাব সম্পর্কে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ইয়ং পাওয়ার ইন সোস্যাল অ্যাকশনের (ইপসা) সমন্বয়ক মোহাম্মদ আলী শাহিন বলেন, ভাঙার জন্য এখন যেসব জাহাজ আসছে, সেগুলো মূলত ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন। কিন্তু কঠোর আইনের জন্য নিজেদের দেশে তারা এসব ভাঙতে পারে না। তাই পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে। যেখানে অধিকাংশ শিপ ইয়ার্ডে পরিবেশসম্মতভাবে জাহাজ ভাঙা হয় না। বাংলাদেশে কেবল একটি মাত্র ইয়ার্ড গ্রিন হিসেবে সনদপ্রাপ্ত। আদতে ইউরোপের শিপিং কোম্পানিগুলোর বর্জ্যের আঁস্তাকুড় হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে বাংলাদেশ। পলিউটারস শুড পে—এ নীতিতে এসব শিপিং কোম্পানির আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে। তা নাহলে দিন দিন সীতাকুণ্ডসহ আশপাশের এলাকার মাটি-পানি বিষাক্ত ধাতুতে পূর্ণ হতে থাকবে, যা দিনশেষে মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের এপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে এসব ভারী ধাতু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে বিভিন্ন রকমের প্রভাব ফেলে। প্রথমত এসবের কারণে ত্বকের বিভিন্ন রোগ হতে পারে। পরবর্তী পর্যায়ে কিডনি, ফুসফুস ও মস্তিষ্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া এসব ধাতু মানবদেহে ক্যান্সারের মতো রোগও সৃষ্টি করতে পারে।
বিএসডি/এএ