উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে বায়তুন নূর জামে মসজিদ নামে একটি মসজিদ রয়েছে। এ মসজিদের নিরাপত্তায় স্থাপন করা সিসিটিভিতে এবার ধরা পড়েছে পুলিশের এক এসআইয়ের ঘুষগ্রহণের দৃশ্য। এ দৃশ্য ধরা পড়ার পর বেরিয়ে আসছে তার আরও সব অপকর্ম, বেরিয়ে আসছে চারিত্রিক ত্রুটিও।
মাসুদ রানা সম্রাট। সস্ত্রীক থাকেন রাজধানীর উত্তরায়। বাসা থেকে তাকে মাদককারবারি অভিযোগে আটক করে পুলিশ।
সম্রাটকে নিয়ে যাওয়ার সময় আভিযানিক দলের নেতৃত্ব দেওয়া পুলিশের উপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান স¤্রাটের স্ত্রী রুনা আক্তারকে জানান, সম্রাটকে ছাড়াতে চাইলে দশ লাখ টাকা লাগবে। এ নিয়ে চলে দর কষাকষি। শেষ পর্যন্ত নির্ধারণ হয় দুই লাখ টাকা। এসআই মিজানুর রুনাকে বলে যান, এ পরিমাণ টাকা নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে। পাশাপাশি হুমকি দেন, এর অন্যথা হলে মাদক মামলায় সম্রাটকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। পরে রুনা দুই লাখ টাকাসহ মিজানুরের সঙ্গে দেখা করতে যান। বায়তুন নূর জামে মসজিদের সামনে মিজানুরের হাতে ওই টাকা তুলে দেন তিনি। আর এ দৃশ্যটি ধরা পড়ে যায় মসজিদের একটি সিসি ক্যামেরায়। গত ২৪ মার্চ বিকালে এ কা- ঘটে। এসআই মিজানুরের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমে জানা গেছে এমন চাঞ্চল্যকর ভিডিওচিত্র ধারণ হওয়ার বিষয়টি।
উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসআই মিজানুর রহমানের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। ওই সিন্ডিকেট সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তিকে টার্গেট করে এভাবে হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। এভাবে নানা অপকর্মে জড়িত থাকার কারণে স্থানীয় অনেকে এসআই মিজানুর রহমানকে ‘দুরমুজ’ মিজান নামে ডাকেন। নানা অপকর্মের কারণে এর আগেও পুলিশের বিভাগীয় শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে এই পুলিশ কর্মকর্তাকে। কিন্তু দমানো যায়নি তাকে। থানায় মিজানুর রহমানের রাজকীয় চলাচল সবাই জানেন। ৬টি দামি মোটরবাইক এবং ব্যক্তিগত প্রাইভেটকার ব্যবহার করেন। রাজধানীতে ফ্ল্যাটসহ নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন বিপুল সম্পদ। স্থানীয়রা জানান, একেক দিন একেক ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন এসআই মিজানুর রহমান। কখনো ইয়ামাহা ফিজার, কখনোবা হোন্ডা রেপজল।
রুনা জানান, তার স্বামী সম্রাট পেশায় কাপড় ব্যবসায়ী। উত্তরার রাজউক কমার্শিয়াল মার্কেটে শেয়ারে একটি দোকান কেনেন তিনি। এ দোকান নিয়ে কিছু ঝামেলা চলছিল। এর মধ্যেই গত ২২ মার্চ এসআই মিজানুর রহমান প্রথমে তার স্বামীকে দেখা করতে বলেন। দোকানের ঝামেলার কারণে দেখা করতে না পারায় দুদিন পর ২৪ মার্চ সকালে তাদের উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১৬ নম্বর রোডের ১৭ নম্বর বাড়ির বাসায় হাজির হন এসআই মিজানুর রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন আরও তিন পুলিশ সদস্য। তবে একজন ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন সাদা পোশাকে। রুনা জানান, বাসায় তল্লাশিকালে রান্নাঘরে ঢুকে দরজা আটকে দেন পুলিশ সদস্যরা। সেখান থেকে বের হয়ে তারা দাবি করেন, দুই হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট পাওয়া গেছে বাসায়। পুলিশ তার স্বামীকে নিয়ে চলে গেলে রুনা আক্তার আইএফআইসি ব্যাংকের উত্তরা শাখা থেকে দুই লাখ টাকা তুলে আনেন। পরে বিকালে সেই টাকা ১১ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদের সামনে এসআই মিজানুরের হাতে তুলে দেন রুনা আক্তার।
১১ নম্বর সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদের ১৪ নম্বর ক্যামেরায় ধরা পড়ে টাকা লেনদেনের চিত্র। এতে দেখা যায়, বিকাল ৪টা ২৩ মিনিটে এসআই মিজানুর রহমান একটি লাল রঙের টি শার্ট পরে মসজিদের সামনে আসেন। এর পর পর এক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে হাজির হন রুনা আক্তার। কথা বলতে বলতে রুনা আক্তারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে যান এসআই মিজানুর রহমান।
টাকা নিয়েও সম্রাটকে না ছেড়ে জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন মিজানুর। এমন অভিযোগ তুলে গত ১ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরের আইজিপিস কমপ্লেইন সেলে লিখিত অভিযোগ করেন রুনা আক্তার। অভিযোগের সঙ্গে মিজানুর রহমান ও তার কথোপকথনের বেশ কয়েকটি অডিও ক্লিপও যুক্ত করে দেন তিনি।
রুনা আক্তার বলেন, ‘টাকা নিয়েও আমার স্বামীকে ছাড়েনি এসআই মিজানুর রহমান। শুধু তাই নয়, টাকা নিয়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় মিজানুর ফের আমাদের বাসায় আসেন। তখন তিনি আমাকে জানান, মাত্র ৩০০ পিস ইয়াবা দিয়ে আমার স্বামীকে মামলা দিয়ে চালান করে দিয়েছে। এ সময় তিনি আমাকে এমন একটি প্রস্তাব দিয়ে বসেন যে, আমি হতভম্ব হয়ে যাই।
রুনা বলেন, মিজান আমাকে কুপ্রস্তাব দিয়ে বলেন সম্মতি জানালে মামলার তদন্ত হালকা করে দেবেন। শুধু আমাকেই নয়, এমন অনেকেই আছেন, যাদের স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর অসহায় স্ত্রীদের তিনি কুপ্রস্তাব দিয়েছেন এবং বাধ্য করেছেন তার অন্যায় ইচ্ছায় সম্মতি দিতে। রুনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, যে সব মামলা মিজানুরের হাতে ছিল, সেগুলোর সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালালে এমন অনেক ভূক্তভোগীর খবর পাওয়া যাবে। রুনা দুঃখ করে বলেন, মিজানুরের অনৈতিক প্রস্তাবে কান না দেওয়ায় ভুগতে হচ্ছে আমাদের। আমি আর কিছু সহ্য করতে পারছি না। আমি এসবের বিচার চাই।’ বলতে বলতে অশ্রুসজল হয়ে পড়েন এ নারী।
পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ করার পর অভিযুক্ত এসআই মিজানুর রহমানকে উত্তরা পশ্চিম থানা থেকে উত্তরখান থানায় বদলি করা হয়। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই মিজানুর রহমান বলেন, ‘সম্রাট একজন পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী। তাকে ধরার কারণে তার স্ত্রী মিথ্যা অভিযোগ করছেন।’ টাকা নেওয়ার বিষয়ে বলেন, ‘স্বামীর জন্য ওষুধ দিতে এসেছিলেন রুনা আক্তার। আমি সরল বিশ্বাসে সেখানে গিয়েছিলাম।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব।’