ওয়াহিদ তাওসিফ মুছা
লালটু সরকার (অন্তর)। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদের তীরেই কেটেছে তার দুরন্ত শৈশব। ঘুরে দাঁড়ানোর অদম্য সাহস, প্রবল ইচ্ছা শক্তি, ধৈর্য আর অধ্যবসায় দিয়ে ৩৮তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে হয়েছেন তৃতীয়। বর্তমানে কর্মরত আছেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর সরকারি মহসিন ডিগ্রি কলেজের দর্শন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। সম্প্রতি বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন বর্তমান সময়কে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ওয়াহিদ তাওসিফ (মুছা)।
বর্তমান সময় – জানার আছে অনেক কিছু্ই তবে আপনার শৈশবের গল্প দিয়েই শুরু করতে চাই।
লালটু সরকার (অন্তর)- আমার শৈশব অন্যদের মতোই দূরন্তপনার মধ্যে কেটেছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের কপোতাক্ষ নদের তীরে আমার জন্ম। পরবর্তীতে তালা বি দে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং তালা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাশ করি। সময়মতো স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, প্রচুর খেলাধুলা করা এবং বাবা-মায়ের শাসনের মধ্যেই বড় হওয়া। এই ছিল আমার শৈশব।
বর্তমান সময়- আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা কি ছিল?
লালটু সরকার (অন্তর)– আমার জীবনের বড় প্রতিবন্ধকতা হলো এসএসসি পরীক্ষার আগে আমার বাবার হঠাৎ মৃত্যু হওয়া। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসার কিভাবে
চলবে তা ছিল সব থেকে বড় প্রশ্ন, আর পড়ালেখা!! আমার কাছে মনে হয়, বেশিরভাগ সময় জীবন আমাদের সাথে কথা বলেনা, শুধুই ধাক্কা দেয়। একেকটা ধাক্কায় জীবন যেন বলে উঠতে চায় ”জেগে ওঠো আমি তোমাকে কিছু শেখাতে চাই’। জীবনের সাথে জগতের এই বিরামহীন যুদ্ধ চলে আমাদের শেষ দিন অবধি।জীবনের বাঁকে বাঁকে নানান প্রতিবন্ধকতা থাকবেই কিন্তু হতাশ হলেও ঘুরে দাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে- অন্ধকারের বিপরীতেই আলো অপেক্ষা করে।
বর্তমান সময়– কিভাবে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন?
লালটু সরকার (অন্তর)– আমার প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠার পিছনে সব থেকে বড় অবদান হলো আমার মায়ের। মা না থাকলে আমার অস্তিতই পাওয়া যেত না।
এছাড়াও আমার কাকা, জেঠা, স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের অপরিমেয় সাহায্য সহযোগিতা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর টিউশন করা। সত্য বলতে সবার সহযোগিতার মাধ্যমেই আমি প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলাম। মানুষের জীবনে বেঁচে থাকার কিছু অবলম্বন প্রয়োজন হয়। যখন দেখবেন জীবনটা বোঝা হয়ে আপনার চেপে ধরতে চাচ্ছে তখন দেখবেন এসব অবলম্বনই আপনাকে বাঁচাবে। সাহস জুগিয়ে আপনার ভিতরের আপনাকে জাগ্রত করে তুলবে।
বর্তমান সময়– বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কিভাবে নিয়েছেন?
লালটু সরকার (অন্তর)– সত্য কথা বলতে প্রথমে বিসিএস নিয়ে আমার ভাবনাই ছিল না, আমি মূলত একজন ব্যাংকার হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাংকে পরপর কয়েকটি ভাইবা দিয়ে ব্যর্থ হয়ে বিসিএসের যাত্রা শুরু করি। যেহেতু আমি ছাত্র জীবন থেকেই টিউশন করাতাম, সেহেতু ইংরেজি আর গণিতে আমার প্রস্তুতি আগে থেকেই হয়ে যায়। আর অন্যান্য বিষয়গুলোআমি নোট করে পড়তাম। এভাবেই বিসিএসের প্রস্তুতি সম্পন্ন করি।
বর্তমান সময়- এত চাকুরী থাকতে বিসিএস কেন?
লালটু সরকার (অন্তর)- একটা সময় যেকোনো চাকরি পাওয়াই ছিল আমার জীবনের মূল লক্ষ্য। তবে অনেক চাকরির মাঝেও বিসিএস ছিল একটা আবেগের জায়গা। কিন্তু বারবার ব্যর্থ হবার সেসব তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই সিদ্ধান্ত নেই কিছু একটা করতে হবে। সেই থেকেই শুরু।
বর্তমান সময়- আপনার সফলতার আড়ালে নিশ্চয় হতাশার অনেক গল্প রয়েছে, সেগুলো জানতে চাই?
লালটু সরকার (অন্তর)– পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়ায় আমার উপর চাপ ছিল পাহাড় সমান। তাই যেকোনো একটি চাকরিই ছিল আমার আশা। এর মধ্যে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে যোগদান করি আর পাশাপাশি সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে থাকি। প্রায় ২৪ টি সরকারি চাকরির ভাইবা দিয়ে কোনো জায়গায় চ’ড়ান্তভাবে নির্বাচিত হই না। তখন আমার স্ত্রী বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলে, আর একজন মহান ব্যক্তির কথা না বললেই নয়, তিনি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক জনাব ড. সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার। তিনি বারবার আমাকে সাহস জুগিয়েছেন।
বর্তমান সময়- দরিদ্রতা কি বিসিএস এর বাধা হতে পারে ? কি মনে করেন?
লালটু সরকার (অন্তর)– দরিদ্রতা বিসিএসের জন্য কোনোভাবেই বাধা হতে পারে না বরং পিএসসি এমন একটি স্বচ্ছ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেখানে
আমাদের মতো দরিদ্র ঘরের সন্তানরা শুধু মেধার জোরে চাকরি পেতে পারে।পরিমিত চেষ্টার পর আপনার সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা করুন। সফলতা আসবেই।
বর্তমান সময়– পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরনা যুগিয়েছে? কাকে বেশি মনে পড়ে?
লালটু সরকার (অন্তর)– সত্য কথা বলতে পর্দার আড়ালে অনেকেই আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। তার মধ্য অন্যতম হলো আমার স্ত্রী। আমি মাঝে মাঝে হাল ছেড়ে
দিলেও সে আমাকে ভরসা ও সাহস জোগাতো। এছাড়াও আমার বন্ধু শিপন ও সোহাগ সর্বদায় বলতো ‘তোর দ্বারা ভালো কিছু হবে’।
বর্তমান সময়– ভবিষ্যতে কি পরিকল্পনা কি রয়েছে?
লালটু সরকার (অন্তর)– আজও বারবার বাবাকে খুব অনুভব করি। বাবা বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন। আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো, শিক্ষা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি
গ্রহন করা, লেখালেখি করা, আর আমার কর্মদক্ষতা দ্বারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠন বাস্তবায়ন করা।
বর্তমান সময়– নতুন যারা বিসিএসে আসতে চায় তাদের জন্য কি পরামর্শ থাকবে?
লালটু সরকার (অন্তর)– যারা বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদের উদ্দেশ্যে একটি কথায় বলবো, আপনারা নিজের প্রতি বিশ্বাস রেখে রুটিনমাফিক
পড়াশোনা চালিয়ে যান, সফলতা আপনাদের সামনে ধরা দিবেই।
বর্তমান সময়– বারবার চাকুরী পরীক্ষা দিয়েও বার্থ হয়েছেন, হতাশ হতে হয়েছে নিশ্চয়। কিভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন?
লালটু সরকার (অন্তর)– আসলে চাকরি না পাওয়াকে আমি ব্যর্থতা বলি না, বরং আমি আমার দুর্বলতাকে খোজার চেষ্ঠা করে আবার নতুন করে শুরু করতাম।
বর্তমান সময়– বিসিএস শিক্ষায় সুপারিশপ্রাপ্ত তালিকায় আপনার নাম দেখার পর সেই অনুভূতি কেমন ছিল?
লালটু সরকার (অন্তর)– বিসিএসের চ’ড়ান্ত ফলাফলে সাধারন শিক্ষা ক্যাডারে নিজের নাম খুজে পাওয়া ছিল আমার জীবনের অন্যতম একটা সেরা মুহুর্ত। আর
বাস্তবিক অর্থে কিছু অনুভূতি কখনো প্রকাশ করা যায় না। আমাদের চারপাশে কত কিছুই ত ঘটে তার সব কি আমরা জানি? থাকুক না কিছু অজানা অনুভূতি !
বর্তমান সময়– আমাদের সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
লালটু সরকার (অন্তর)- আপনাকেও ধন্যবাদ।