কৃষি ডেস্কঃ
সম্ভাবনাময় ফসল পেরিলা চাষ করে বেশ ভালো লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এটি চাষ করে দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদাও অনেকাংশ মেটানো সম্ভব।
পেরিলা বাংলাদেশে অভিযোজিত একটি নতুন ভোজ্যতেল ফসল। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকূলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক সাউ পেরিলা-১ (গোল্ডেন পেরিলা বিডি) নামে বাংলাদেশে প্রথম এর একটি জাত নিবন্ধিত হয়। জাতটি এখন মাঠ পর্যায়ে চাষ শুরু হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার (এলআর) ও পিএইচডি ফেলো ইন পেরিলা অয়েল ক্রপ (শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ূম মজুমদার বলেন, পেরিলা মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার জাত যা কোরিয়ান পেরিলা নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Perilla frutescens (L.) Britton এবং এটি Lamiaceae (Mint) পরিবারভুক্ত। এটি এখন বাংলাদেশের মাটিতে যে কেউ চাষ করতে পারেন। তবে চাষের আগে কয়েকটি বিষয়ে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
সাউ পেরিলা-১ (গোল্ডেন পেরিলা বিডি) উৎপাদন প্রযুক্তি সম্পর্কে যা জানা প্রয়োজন
পানি জমে থাকে না- এমন প্রায় সব ধরনের মাটিতে এ ফসল চাষের উপযোগী। তবে বেলে দোঁ-আশ বা দোঁ-আশ মাটি পেরিলা চাষের জন্য বেশি ভালো।
বীজতলা তৈরি, বীজ বপন ও জমি তৈরি
খরিপ-২ মৌসুম, বীজ বপনের উপযুক্ত সময় ১০ জুলাই-২৫ জুলাই। পেরিলা অত্যন্ত ফটোসেনসেটিভ ফসল। সাধারণত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে পেরিলা গাছে ফুল আসা শুরু হয়।
কাজেই গাছের পর্যাপ্ত অঙ্গজ বৃদ্ধি এবং কাঙ্ক্ষিত মাত্রার ফলন পেতে হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অবশ্যই বীজ বপন করতে হবে। প্রতি হেক্টরে এক থেকে দেড় কেজি বীজের প্রয়োজন হয়। বীজতলার প্রস্থ এক থেকে দেড় মিটার হবে। দৈর্ঘ্য জমির আকার অনুযায়ী যেকোনো মাপে নেওয়া যাবে। বীজতলায় জৈবসারের ব্যবস্থা করলে স্বাস্থ্যবান চারা পাওয়া যাবে।
বীজতলায় দুই বেডের মাঝে নালার ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে বৃষ্টি হওয়ার পর অতিরিক্ত পানি বীজতলায় জমে না থাকতে পারে। বীজের আকার ছোট হওয়ায় মাটি যথাসম্ভব ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। পিঁপড়ার আক্রমণ যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। খরিপ-২ মৌসুমে বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকায় বীজ বপনের পর প্রথম ১৫ দিন পর্যন্ত বীজতলার চার পাশে খুঁটি দিয়ে উঁচু করে পলিথিন দেওয়া যেতে পারে।
১/৪ ইঞ্চি গভীর লাইন করে বীজ বপন করলে বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা বাড়ে। অথবা বীজ ছিটিয়ে দিয়ে ঝুরঝুরে মাটি উপরে দিয়ে দিতে হবে। বীজ বপনের পর বীজতলায় হালকা করে পানি দিতে হবে। বীজতলা যেন একেবারে শুকিয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল করতে হবে।
চার থেকে পাঁচটি আড়াআড়ি চাষ এবং মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে জমি তৈরি করতে হবে। জমির চারপাশে নালার ব্যবস্থা করলে পানি নিষ্কাশনের জন্য সুবিধা হবে। গাছ থেকে গাছের দূরত্ব ৩০-৪০ সেন্টিমিটার এবং লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব ৩০-৪০ সেন্টিমিটার বজায় রেখে চারা রোপণ করতে হয়।
চারা রোপণ
বীজ বপনের ২৫-৩০ দিন পর চারা রোপণের উপযোগী হয়। এ সময় প্রতিটি চারায় পাঁচ থেকে ছয়টি পাতা হয়। চারা উত্তোলনের সঙ্গে সঙ্গেই রোপণ করতে হবে।
চারা উত্তোলনের পর চারার আঁটি বাঁধার সময় শিকড়ে মাটি রেখে দিলে রোপণের পর গাছের দ্রুত বৃদ্ধিতে উপকার হয়। মূল জমিতে সাধারণত দুই মিটার প্রশস্ত বেড তৈরি করে চারা রোপণ করলে পানি নিষ্কাশনের জন্য ভালো হয়।
দুই বেডের মাঝে ২০-৩০ সেন্টিমিটার প্রশস্ত নালা রাখতে হবে। সাধারণত বেড তৈরি ছাড়াও চারা রোপণ করা যায়। সেক্ষেত্রে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। চারা রোপণের পর পরই হালকা সেচ দিতে হবে।
সেচ ও নিষ্কাশন
বর্ষাকাল বা খরিপ-২ মৌসুমে পেরিলার চাষ হওয়ায় সাধারণত সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে ফুল আসার সময় একটানা ১৫-২০ দিন বৃষ্টি না হলে হালকা সম্পূরক সেচের প্রয়োজন হতে পারে। জমিতে যেন পানি জমে না থাকে সেজন্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
অন্যান্য পরিচর্যা
চারা রোপণের ১০-১৫- দিন পর প্রথমবার এবং ২৫-৩০ দিন পর দ্বিতীয়বার নিড়ানি দিতে হয়। এ ফসলে সাধারণত রোগ এবং পোকামাকড়ের আক্রমণ খুবই কম হয়। তবে কাটুই পোকা, হক মথ, বিছা পোকা প্রভৃতি পোকার আক্রমণ দেখা দিতে পারে। ক্ষতির ধরন দেখে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা নিতে হবে।
বীজ বা ফসল পরিপক্বতার সময়
চারা রোপণের ৭০-৭৫ দিনের মধ্যে পেরিলা ফসল সংগ্রহ করা যায়। সাধারণত বীজ পরিপক্ব হলে গাছের পাতা ঝরে যায়। গাছের পাতা ৮০ শতাংশ হলুদ হলে বীজ ধূসর রং ধারণ করে এবং বীজ সংগ্রহের উপযোগী হয়। বাইরের দিক থেকে বীজ দেখা যায় বলে বীজের পরিপক্বতা সহজেই বুঝা যায়।
ফসল মাড়াই/সংগ্রহ পদ্ধতি
বীজে পরিপক্বতা আসার পর গাছের গোঁড়া কেটে দিতে হয় অথবা পুরো গাছ উপড়ে ফেলতে হয়। তারপর শক্ত চটের বস্তা অথবা শক্ত পলিথিন বা ত্রিপল বিছিয়ে গাছগুলো ধরে হালকাভাবে পিটিয়ে বীজ সহজেই সংগ্রহ করা যায়। হেক্টরে এক দশমিক তিন থেকে এক দশমিক পাঁচ টন ফলন হয়ে থাকে।
বীজ সংরক্ষণ
বীজ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। বীজের আর্দ্রতা সাত থেকে আট শতাংশ হলে বীজ টিন অথবা প্লাস্টিকের পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে। বীজ সংরক্ষণের পাত্রে বাতাস যেন চলাচল না করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সংরক্ষিত বীজ যথাসম্ভব আর্দ্র নয় এমন ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। সংরক্ষণের জন্য বীজভর্তি পাত্র মাটির সংস্পর্শে রাখা বাঞ্ছনীয়।
বিএসডি/এএ