করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রথম দফায় ২০২০ সালের মার্চে দেশে থাবা বসালে ওই বছর প্রায় ৫৯ লাখ দরিদ্র পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু এ বছর করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়লেও এখন পর্যন্ত দলটিকে সেভাবে ত্রাণ বিতরণ বা সহায়তামূলক কোনো কর্মসূচিতে সবর দেখা যায়নি। অবশ্য ব্যক্তিপর্যায়ে দু’এক জায়গায় বিএনপির কেউ কেউ অসহায়-দুস্থদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
দলীয় সূত্রমতে, করোনায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ অন্তত পাঁচ হাজার নেতাকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফসহ ৪৪০ নেতাকর্মী। ফলে অনেকে করোনা নিয়ে উদ্বেগের কারণে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না।
অপরদিকে বিএনপির অভিযোগ, সরকারের দমন–পীড়নে তাদের নেতাকর্মীরা বিপর্যস্ত । অনেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারছেন না। এর মধ্যে আবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সিনিয়র নেতাদের মধ্যে অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। বেশ কয়েকজন চিকিৎসার পরে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। বর্তমানে আক্রান্ত আছেন শতাধিক নেতা। অনেকে আবার সপরিবারে আক্রান্ত। এমন পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত করতে হয়েছে দলটিকে।
করোনার কারণে গত বছর প্রায় টানা ছয় মাসের মতো বিএনপির সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড একেবারেই বন্ধ ছিল। এরপর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু হলেও ভাইরাসটির কারণে খুব বেশি সুবিধা করে উঠতে পারেনি দলটি। এ বছরও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড স্থগিত করেছে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব। এমনকি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর কর্মসূচিও স্থগিত করা হয়।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, ডা. একেএম আজিজুল হক, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সেলিমুজ্জামান সেলিম, শরীফুল আলম, ভোলা জেলা বিএনপির সভাপতি গোলাম নবী আলমগীর, সাবেক ছাত্রনেতা রকিবুল ইসলাম বকুল, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন মিডিয়া কমিটির সদস্য আতিকুর রহমান রুমন, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল, বিএনপির প্রেস উইংয়ের ফটোসাংবাদিক বাবুল তালুকদার প্রমুখ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ সুস্থও হয়েছেন। আবার কারও কারও শারীরিক অবস্থার অবনতিও হয়েছে।
এর মধ্যে নেতাদের অনেকে সপরিবারে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যেমন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী বিলকিস আক্তার হোসেনও হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এখন অনেকটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন।
ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেনের সঙ্গে তার স্ত্রী রিফাত হোসেনও করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের স্ত্রী কামরুন নাহার সৃষ্টি, দুই মেয়ে জান্নাতুন ইসি সূচনা ও অপরাজিতা খানও আক্রান্ত হয়েছেন। সেলিমুজ্জামান সেলিমের স্ত্রী সাবরিনা শুভ্রাও করোনা আক্রান্ত হয়েছেন।
সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অনেকটা সুস্থ হলেও এখনো পরিপূর্ণ সুস্থ হননি। তিনি হাসপাতালেই রয়েছেন। তার স্ত্রী আরজুমান আরা বেগম হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলে তাকে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এছাড়া দলীয় প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও তার বাসার নয়জন করোনা আক্রান্ত হন। যদিও অন্যরা সুস্থ হয়ে গেছেন , তবে খালেদা জিয়া এখনো পরিপূর্ণ সুস্থ নন। পাশাপাশি তার রয়েছে নানা জটিলতা। রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তার চিকিৎসায় সাত এবং তার ব্যক্তিগত তিন চিকিৎসকসহ ১০ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ অন্য রোগে মারা গেলেও করোনার কারণে এরই মধ্যে মারা গেছেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এমএ হক, সাবেক মন্ত্রী টিএম গিয়াস উদ্দিন, ঢাকা উত্তর মহানগর বিএনপি সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসান, কুমিল্লা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আউয়াল খান, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. মামুন রহমান, সাবেক সংসদ সদস্য আমজাদ হোসেন সরকার প্রমুখ।
বিএনপি সূত্র জানায়, দলের কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে করোনা আক্রান্ত এবং মারা যাওয়া নেতাদের তালিকা নিয়ে কাজ করছেন সহ-দফতর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, বেলাল আহমেদ ও মুনির হোসেন।
তারা হাইকমান্ডের বার্তা তৃণমূলের নেতাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে করোনায় আক্রান্ত ও মারা যাওয়া নেতাকর্মীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করছেন তারা।
বিএনপির দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘গোটা বিশ্বে করোনা মহামারি আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। এই ভাইরাসে আমাদের ৪০০-এর অধিক নেতাকর্মী মারা গেছেন। পাঁচ হাজার নেতাকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। আমরা ভার্চুয়ালি নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। আর যাদের সুযোগ আছে দলের ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের সহায়তা করতে বলা হয়েছে।’
গত বছর বিএনপির পক্ষ থেকে ত্রাণ তৎপরতা দেখা গেলেও এবার নেই কেন? এর উত্তরে প্রিন্স বলেন, ‘একটি দলের পক্ষ থেকে সবাইকে সহযোগিতা করা সম্ভব নয়। এরপরও গত বছর সর্বোচ্চ সহায়তা কার্যক্রম চালানো হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে দলের নেতাকর্মীদের অবস্থা ভালো নেই। বিশেষ করে ত্রাণ তৎপরতায় যারা অংশ নেবেন তাদের অধিকাংশ করোনায় আক্রান্ত। এ বছরে অন্তত আড়াই হাজার নেতাকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা গত বছর সরকারকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু সরকার আমাদের কথা রাখেনি। এবারও আমাদের মহাসচিব দলের পক্ষ থেকে এই মহামারি মোকাবিলায় সরকারকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছেন।’
এবার বিএনপির ত্রাণ তৎপরতা না থাকা প্রসঙ্গে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘১৪ বছর ধরে বিএনপির ওপর সরকারের নির্যাতন চলছে। যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, তাদের অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। তাদের চূড়ান্ত হয়রানির মধ্যে রাখা হয়েছে। এরপরও নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ঘরে থেকেই যতটুকু সম্ভব অসহায় মানুষের জন্য করে যেতে। সীমিত শক্তির মধ্যে যতটুকু করা যায়, সেটি করে যাবে বিএনপি।’