আট বছর আগে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ-সহিংসতায় ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। এবার আরেক সহিংসতায় আলোচনায় এল সংগঠনটি। তবে এবার সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে কঠিন সংকটে পড়েছে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক এই সংগঠন।
২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধ করছিল ১৩ দফা দাবিতে। সারা দেশ থেকে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকেরা যোগ দিয়েছিলেন। ওই দিন রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের মুখে হেফাজত ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও পরবর্তী সময়ে সরকার আর তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতা দেখায়নি। বরং হেফাজতের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ ও সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, তাদের বিভিন্ন দাবিও মেনে নিয়েছিল। তবে এবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, ১৭ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানির পর সরকার শক্ত পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে।
এই মুহূর্তে মামলা, গ্রেপ্তার এবং সরকারি মহলের নানামুখী চাপে বেশ কোণঠাসা অবস্থায় পড়েছে হেফাজতে ইসলাম। কমিটি বিলুপ্তির পর কার্যত সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ। কিন্তু হেফাজতের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আমির (বর্তমানে আহ্বায়ক) জুনায়েদ বাবুনগরী ও প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর সমর্থকদের মধ্যে বিভক্তি ক্রমেই দানা বাঁধছে। দুই পক্ষই সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। এমন প্রেক্ষাপটে হেফাজতের নেতৃত্ব এবং এর ভবিষ্যৎ কী, তা নিয়ে নানা রকম আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে বিভিন্ন মহলে।
হেফাজত-সংশ্লিষ্ট চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বলছেন, নানামুখী বিতর্ক ও চাপে কোণঠাসা অবস্থায় পড়া হেফাজত অদূর ভবিষ্যতে আরও দুর্বল বা এর কার্যক্রম থেমেও যেতে পারে। তবে এর অর্থ এই নয় যে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই ধর্মীয় গোষ্ঠীর তৎপরতা থেমে যাবে। তাঁদের ধারণা, হেফাজত থেমে গেলে ভবিষ্যতে নতুন কোনো ইস্যুতে অন্য নামে সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়ে গবেষণা আছে, এমন চিন্তাশীল ব্যক্তিদের অনেকে হেফাজতে ইসলামের কোনো ভবিষ্যৎ নেই বলে মনে করেন। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বলেন, হেফাজতে ইসলাম হচ্ছে একটি প্রতিক্রিয়াশীল অক্ষম ভাবাদর্শ। তাদের ১৩টি দাবির একটি ছাড়া অন্যগুলোর যৌক্তিকতা নেই।
হেফাজতের ঘনিষ্ঠজনেরা বলছেন, সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্বে বড় ধরনের গুণগত পরিবর্তন ঘটে। তাঁরা বলছেন, আহমদ শফী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ আলেম ছিলেন। তাঁকে সবাই মান্য করতেন। কোনো বিষয়ে তাঁর কথা অপছন্দ হলেও কেউ মুখ খুলে বলতেন না। কিন্তু এখন আর সেই পরিবেশ নেই।
হেফাজতের কার্যক্রমকে নিবিড়ভাবে দেখছেন—এমন ব্যক্তিদের কারও কারও মূল্যায়ন হচ্ছে, এই পরিবর্তনটা শুরু হয় শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর কয়েক মাস আগে থেকে। এর প্রকাশ ঘটে ছাত্র বিক্ষোভের মুখে হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে তাঁর অব্যাহতি নেওয়ার মধ্য দিয়ে।
এর বাইরে গত এক-দেড় বছরে সারা দেশে বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কওমি আলেম মারা গেছেন, যাঁরা হেফাজতের অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁদের অবর্তমানে হেফাজতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একধরনের সংকট তৈরি হয়। এ ছাড়া সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের ঘটনায় হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্বের নৈতিক অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এটি হেফাজতের জন্য একটি বড় ধরনের ধাক্কা, যা হেফাজতবিরোধী অভিযানে সরকারের জন্য সহায়ক হয়েছে।
হেফাজতের কর্মকাণ্ড ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন ইসলামবিষয়ক লেখক ও গবেষক শরীফ মুহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘এই প্রজন্মের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে চিন্তার আদান-প্রদান অনেক বেশি সক্রিয়। আধুনিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও তাঁরা সমানভাবে পারঙ্গম। ফলে হেফাজতে ইসলাম থাকল কি থাকল না, এটি কার নিয়ন্ত্রণে গেল, কী গেল না, সেটি ফ্যাক্টর হবে বলে মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে হয়তো নতুন কোনো ব্যানার হবে।’
২০১০ সালের সরকার প্রণীত নারী নীতিমালার বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক আহমদ শফীর নেতৃত্বে। তখন ১৩ দফা দাবি সামনে রেখে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর উত্থান ঘটে ২০১৩ সালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করে মাঠে নামার পর। ব্যাপক আলোচনায় আসে ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে অবস্থানের পর। এরপর সংঘাত–সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ওইদিন ও পরদিন বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষে অন্তত ৩৯ জন নিহত হন।
এরপর অবশ্য হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সম্পর্ক ভালো ছিল। আহমদ শফীর কাছে সরকারের মন্ত্রী, সাংসদ ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের যাতায়াত ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, আহমদ শফীর মৃত্যুর পর জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির করে হেফাজতের যে কমিটি হয়, সেটা সরকারের মনঃপূত ছিল না। কারণ, বাবুনগরী সরকারি মহলের পছন্দের তালিকায় ছিলেন না। তাঁর কমিটিতে সরকারঘনিষ্ঠ নেতাদের রাখা হয়নি। ফলে আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানি ও তাঁর অনুসারীরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। এখন ওই অংশটিও তৎপর হয়েছে কমিটি পুনর্গঠনে। এঁদের অন্যতম হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাঈনুদ্দীন রুহী। তিনি গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম যদি আল্লামা শফীর নীতি-আদর্শের মধ্যে না আসে, তাহলে এই হেফাজতের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি শঙ্কিত।’
মাঈনুদ্দীন রুহীসহ হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, সাবেক সহকারী মহাসচিব হাসানাত আমিনী ও আলতাফ হোসাইন গত রোববার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে তাঁর বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। এর মধ্য দিয়ে এই অংশের গুরুত্ব দৃশ্যমান হলো। বৈঠক সম্পর্কে মাঈনুদ্দীন রুহী বলেন, ‘আমরা ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যাপারে কথা বলেছি। এ ছাড়া রোজার মধ্যে যাতে কোনো নিরীহ আলেম এবং মাদ্রাসাগুলোতে হয়রানি না করা হয়, সে জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি।’
সর্বশেষ গতকাল রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন হেফাজতের সদস্যসচিব নুরুল হক জিহাদীসহ আরেক দল নেতা।
হেফাজত-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, সরকার হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারলেও তাঁদের মধ্যে হয়তো একটা ফাটল ধরাতে পারবে। কিন্তু এর শেষ ফল কী হবে, তা আগাম বোঝা মুশকিল। তবে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, মামলার চাপ ও চলমান গ্রেপ্তার ও হয়রানির ঘটনাগুলো কওমি মাদ্রাসার নতুন প্রজন্মকে আরও রাজনীতি ঘনিষ্ঠ করবে তুলবে।