ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে। সড়কে নামছে নানা ফ্যাশনের বাহারি সব গাড়ি। বলতে গেলে, ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে প্রায় দুই কোটি মানুষের রাজধানী শহর এখন মুমূর্ষু।
সর্বশেষ বিভিন্ন সমীক্ষা বলছে, ঢাকায় যানজটে গড়ে দিনে নষ্ট হচ্ছে প্রায় ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা। বছরে এই মহানগরে যানজটে ক্ষতি হচ্ছে কমপক্ষে এক লাখ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) গত আগস্ট মাস পর্যন্ত নিবন্ধিত গাড়ির পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকায় নিবন্ধিত মোট গাড়ির তুলনায় শুধু মোটরসাইকেলই নিবন্ধিত হয়েছে ৪৯ শতাংশ। প্রাইভেট কার (ব্যক্তিগত গাড়ি) নিবন্ধিত হয়েছে ১৮ শতাংশ। আর বাস নিবন্ধিত হয়েছে দুই শতাংশ। অর্থাৎ গণপরিবহনের তুলনায় ব্যক্তিগত ও ছোট গাড়ির নিবন্ধন বেশি হয়েছে।
বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্ট পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছে মোট ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪টি গাড়ি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল আট লাখ ৪৯ হাজার ৩৩৫টি, প্রাইভেট কার তিন লাখ আট হাজার ৮৬০টি, বাস ৩৬ হাজার ৯৭৮টি।
ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনার তৈরির জন্য বিভিন্ন সমীক্ষা হয়েছে। এসব সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ঢাকায় প্রায় ৮০ শতাংশ যাতায়াত পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে, যার অর্ধেক আবার কিলোমিটারের মধ্যে। স্বল্প দূরত্বের যাতায়াতের জন্য সাইকেলে বা হেঁটে নিরাপদে চলাচলের পরিবেশ তৈরি করা দরকার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সেই সঙ্গে অধিক দূরত্বের জন্য গণপরিবহন নিশ্চিত করার সুপারিশ ও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তাতে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
সমীক্ষা বলছে, বর্তমানে ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়িতে ১০ শতাংশেরও কম ট্রিপ হয়ে থাকে। ঠিক এমন পরিস্থিতিতে বুধবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হচ্ছে দেশে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘গণপরিবহনে ও হেঁটে চলি, ব্যক্তিগত গাড়ি সীমিত করি’।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হকের মতে, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ব্যক্তির ব্যবহারের জন্য ছোট গাড়ির নিবন্ধন নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বহু আগে থেকেই সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে তা মানা হয়নি। ফলে রাজধানী ঢাকা এখন মুমূর্ষু। এখানে পরিবহন ব্যবস্থার অপচিকিৎসা চলছে। নগরের পরিবহন ব্যবস্থা সুপরিকল্পিত নয়।
১০ বছরে ঢাকায় নিবন্ধিত গাড়ি বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে কর্মসংস্থানের বড় সুযোগ; শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা রাজধানীমুখী। এ কারণে মানুষের মূল স্রোত রাজধানীকেন্দ্রিক। আর তাই মানুষের যাতায়াতের চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গাড়ি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, দেশে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার হার অন্তত এক দশমিক ৪৭ শতাংশ। ঢাকায় এ হার তিন দশমিক ৮২ শতাংশ। সারা দেশের তুলনায় তা দুই দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি। দেশের জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বসবাস ঢাকা ও এর আশপাশে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, রাজধানীর সড়কে সর্বোচ্চ দুই লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলতে পারে। অথচ এখন পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছে ১৭ লাখের বেশি গাড়ি। বিআরটিএ’র পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় নিবন্ধিত হয়েছিল পাঁচ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭টি গাড়ি। এখন (গত ৩১ আগস্ট পর্যন্ত) তা বেড়ে হয়েছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪টি । ঢাকায় নিবন্ধিত ২০ ধরনের গাড়ির মধ্যে ছোট গাড়ির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সমীক্ষানুসারে, ঢাকায় গণপরিবহনে প্রতিদিন ২১ লাখ ট্রিপের প্রয়োজন। কিন্তু গণপরিবহনের অভাবে অর্ধেক ট্রিপও হয় না। সড়ক দখলে রাখছে ব্যক্তিগত ও ছোট ছোট গাড়ি।
ঢাকার সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) (২০১৫-২০৩৫) পথচারীদের চলাচলের অগ্রাধিকার, সাইকেলে চলাচলের নিরাপদ পরিবেশ তৈরি ও গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের সুপারিশ রয়েছে। আরএসটিপির তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়িতে সাত শতাংশ ট্রিপ হয়, তাতে সড়কের ৭০ শতাংশ স্থান দখল হয়। কিন্তু বাস, রেল, নৌপথ, হাঁটা ও রিকশায় ৯৩ শতাংশ চলাচল হয়। হাঁটা ও গণপরিবহনকে প্রাধান্য না দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়িকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তাতে যানজট ছাড়াও জ্বালানির অপচয় ও দূষণ বেড়ে চলেছে।
হেলথ ব্রিজ ফাউন্ডেশন অব কানাডার আঞ্চলিক পরিচালক দেবরা ইফরইমসন ঢাকার পরিস্থিতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে গত ১৮ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বলেন, নগরের যাতায়াত ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত গাড়িবান্ধব প্রকল্প (ফ্লাইওভার, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) থেকে বের হয়ে অযান্ত্রিক যান, পথচারীদের প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞ গাউস পিয়ারীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় দিনে প্রায় সাড়ে তিন কোটির বেশি ট্রিপ হয়। ১০ বছরে যানজট নিরসনে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। ১০ বছর আগের চেয়ে গাড়ির গতি কমে দাঁড়িয়েছে ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার।
বিশেষজ্ঞ আবু নাসের খান বলছেন, বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। জনসংখ্যা ও গাড়ি বেড়ে যাওয়ায় ঢাকার রাস্তায় হাঁটাও কষ্টকর। ফুটপাতে মোটরসাইকেলের জন্য পথচারীরা হাঁটতে পারেন না।
ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ব্যাপকতা পায় ৭০’র দশকে জ্বালানি সংকটকালে। ১৯৭৪ সালে সুইজারল্যান্ডে গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। ৯০’র দশকে এ উদ্যোগের আরও বিস্তার ঘটে। ২০০১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বিশ্বের ৩৩টি দেশের প্রায় এক হাজার শহরে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস উদযাপন করা হয়। বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় চার হাজার শহরে দিবসটি পালিত হয়।
বাংলাদেশে ২০০৬ সাল থেকে বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে ধারাবাহিকভাবে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস পালন করা হয়। পরে ২০১৬ সাল থেকে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, এবার ৬২টি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগে বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস উদযাপন করা হবে। প্রতি বছরই দিবসটিকে কেন্দ্র করে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউয়ের সামনে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে করোনা সংক্রমণের বিষয়টি মাথায় রেখে এ বছর দিবসটি উপলক্ষে কর্মসূচি সাজানো হয়েছে ভিন্নভাবে। এবারের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ছাত্রছাত্রীদের হাঁটা ও সাইকেল চালানো এবং স্কুল বাসে চলাচলের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে রচনা প্রতিযোগিতা, সাইকেল র্যালি ও পদযাত্রা।
দিবসটি উপলক্ষে বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সভাকক্ষে ‘গণপরিবহনে ও হেঁটে চলি, ব্যক্তিগত গাড়ি সীমিত করি’ শীর্ষক কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার সম্মতি দিয়েছেন।
বিএসডি/এমএম