নিজস্ব প্রতিবেদক:
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার হদ্দের ভিটার এলাকার ভ্যানচালক আব্দুল মান্নান। পাঁচ মাস আগে একটি তুচ্ছ ঘটনায় প্রতিবেশীর হামলায় স্ত্রী মধুমালাকে হারিয়েছেন তিনি। এরপর হত্যা মামলা দায়েরের পর চার্জশিট পেতে দিনের পর দিন ঘুরছেন থানার বারান্দায়।
খালি চোখে মনে হতে পারে এটি শুধু পুলিশেরই গাফিলতি বা অনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কিছু। তবে ময়মনসিংহের বাস্তবতা একটু ব্যতিক্রম। শুধু মেডিকেল রিপোর্ট না পাওয়ায় মান্নানের মতো আরও অনেকের মামলাই দেখছে না আলোর মুখ।
আব্দুল মান্নান বলেন, স্ত্রীকে হত্যার পাঁচ মাস চলে গেছে অথচ আমি মামলা এগিয়ে নিতে পারছি না। এ পর্যন্ত আমি কমপক্ষে ২০ বার থানায় এসেছি। কিন্তু থানা থেকে বলা হচ্ছে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পেলে তারা প্রতিবেদন দিতে পারবেন না। আমি অনেকবার হাসপাতালেও গিয়েছি। এখন আমি অপারগ।
একই রকম সমস্যা নিয়ে থানায় এসেছেন ধানীখোলা ভাটিদাসপাড়া গ্রামের সোহেল মিয়া। জমি সংক্রান্ত বিরোধে মারামারির ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন পরিবারের সাতজন। গত ১৬ মে ৯ জনের নামে মামলা করলেও মেডিকেল সার্টিফিকেট না পাওয়ায় এগিয়ে নিতে পারেননি মামলাটির কার্যক্রম।
তিনি বলেন, প্রতিপক্ষ আমাদের মারধরের পর আমরা হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। কিন্তু এর বিচার হচ্ছে না। মেডিকেল সার্টিফিকেটের জন্য মামলার কিছুই করতে পারছি না। কোথায় যাব এখন আমরা?
এ ব্যাপারে ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত (ওসি) কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন বলেন, প্রতিটি মামলায় পুলিশি তদন্ত শেষ হলেও যে সমস্ত রিপোর্টে মেডিকেল রিপোর্টের প্রয়োজন হয়, সেই মেডিকেল রিপোর্টগুলো যথাসময়ে আমরা পাই না। মেডিকেল রিপোর্ট বিলম্বে পাওয়ার কারণে আমাদেরও আদালতে পুলিশ প্রতিবেদন পাঠাতে দেরি হয়।
জেলা পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মেডিকেল রিপোর্টের জন্য ময়মনসিংহে ঝুলে আছে ৮৫৯টি মামলার পুলিশ রিপোর্ট। এর মধ্যে ছয় মাসের পুরোনো ১২০টি রিপোর্ট ও এক বছরের পুরোনো ২৯টি রিপোর্ট আছে। মিলছে না ২১৫টি ধর্ষণ ও ৬২টি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট। এতে আটকে আছে মামলার কার্যক্রম।
পরিসংখ্যান ঘেটে দেখা গেছে, আগস্ট পর্যন্ত ঝুলে থাকা ৮৫৯ মামলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ২১০টি মামলা রয়েছে কোতোয়ালি মডেল থানায়। এছাড়াও ভালুকা ও ঈশ্বরগঞ্জ থানায় ৭৮টি করে, ত্রিশালে ৬১টি, নান্দাইলে ৫৮, গৌরীপুরে ৫৭, ফুলবাড়িয়ায় ৫৬, মুক্তাগাছায় ৪৯, তারাকান্দায় ৪৩, হালুয়াঘাটে ৪১, পাগলায় ৩৪, ফুলপুরে ৩১, ধোবাউড়ায় ২৮, গফরগাঁও থানায় ২৬ এবং গোয়েন্দা শাখায় ৯টি মামলা রয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মোহা. আহমারউজ্জামান বলেন, আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। সেই সঙ্গে বিভিন্ন মিটিংয়ে বিষয়টি নজরে আনার চেষ্টা করি। তারপরও এখনো অনেক রিপোর্ট পেন্ডিং রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রিপোর্টগুলো সংগ্রহ করতে পারি।
এদিকে অভিযোগ রয়েছে, সার্টিফিকেট পরিবর্তনও করে ফেলা যায় নিমিষেই। এক্ষেত্রে সক্রিয় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এমনটি দাবি করে ময়মনসিংহ জেলা জজ আদালতের আইনজীবী শিব্বির আহমেদ লিটন বলেন, আমাদের দেশের ব্যবস্থাপনায় মেডিকেল সার্টিফিকেটটা সঠিক সময়ে আসে না। যার ফলে এখানে তৃতীয় পক্ষের আগমন ঘটে। তখনই অপরাধী সার্টিফিকেটে ট্যাম্পারিং করার চিন্তা করে এবং তৃতীয় পক্ষ সেখানে যোগসাজশ করার চেষ্টা করে। আমরা দেখেছি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই সংযোগটি হয়ে যায়। এতে প্রকৃত সার্টিফিকেটটি যখন আদালতে না আসে তখন বিচারপ্রার্থী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়।
যদিও এমন অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. জাকিউল ইসলাম। তিনি বলেন, এমন কোনো অভিযোগ আমরা এখনো কারও কাছ থেকে পাইনি। কেউ অভিযোগ দিলে অবশ্যই বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিব।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে এই সময়টায় কিছু রিপোর্ট আটকে গেছে। তবে এখন যেহেতু পরিস্থিতি বেশ স্বাভাবিক হয়েছে তাই এই দিকটাতেই নজর দিয়েছি বেশি। ভবিষ্যতে আমরা চেষ্টা করবো এই পেন্ডিংটা যেন একেবারেই রানিং হয়ে যায়।
বিএসডি/আইপি