নিজস্ব প্রতিনিধি:
রাজধানীর অদূরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে গড়ে উঠেছে পুলিশের অত্যাধুনিক মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র ‘ওয়েসিস’। পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে কেরানীগঞ্জের বসুন্ধরা রিভারভিউ প্রকল্পে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। আগামী ১ অক্টোবর এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে।
ওয়েসিস-এর বাংলা অর্থ মরুদ্যান; রুক্ষ, বৃক্ষহীন মরুভূমিতে এক টুকরো সবুজ। দেশে যখন মাদকাসক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে খাঁ খাঁ রোদ্দুরের অবস্থা, তখন ঊষর মরুভূমির বুকে শীতল সবুজ আর নরম বারিবিন্দুর প্রশান্তির প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসছে পুলিশের এই অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র।
পোস্তগোলা ব্রিজ পার হয়ে এক কিলোমিটার গেলেই চোখে পড়বে ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। সম্পূর্ণ অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হবে পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের অধীনে। এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) ড. বেনজীর আহমেদের প্রচেষ্টায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান ও একদল দক্ষ কর্মী।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘মাদকাসক্তদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এখানে সুন্দর ও নান্দনিক পরিবেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে।’
স্বনামধন্য টেকনিশিয়ান ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ কেন্দ্র। তুলনামূলক কম খরচে বিশ্বমানের চিকিৎসা দেওয়া হবে এখানে। আইজিপি মনে করেন, মাদকাসক্তদের উন্নত চিকিৎসার জন্য আর বিদেশে যেতে হবে না।
দেশের অনেক মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসার নামে নির্যাতন করার অভিযোগ আছে। কোনো কোনো নিরাময় কেন্দ্রে মানসম্মত চিকিৎসা দূরের কথা, অপচিকিৎসা-নির্যাতনে রোগীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। আবার কোনো কোনো নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার নামে রোগীকে আটকে রেখে এমনভাবে নির্যাতন করা হয় যে, মুক্তির পর রোগীকে সেই নির্যাতনের ক্ষত বহুদিন বয়ে বেড়াতে হয়। এ প্রেক্ষাপটে পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ওয়েসিস মাদক নিরাময় কেন্দ্রে থাকবে অত্যাধুনিক ডোপ টেস্ট মেশিন ‘গ্যাস প্রমোটোগ্রাফি’। বর্তমানে শুধু প্রস্রাব পরীক্ষা করে ডোপ টেস্ট করা হয়। কিন্তু ‘গ্যাস প্রমোটোগ্রাফি’ মেশিন দিয়ে চুল ও নাক থেকে নমুনা নিয়েও পরীক্ষা করা যাবে। বর্তমানে মাদক গ্রহণের তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করতে হয়। কিন্তু আধুনিক এই মেশিনে মাদক গ্রহণের ১২০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করলেও প্রমাণ পাওয়া যাবে।
চীন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে মাদক নিরাময়ে আকুপাংচার চিকিৎসা বেশ জনপ্রিয় ও কার্যকরী। এখানে সেই ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
পুলিশ সদরদফতর সূত্রে জানা গেছে, সাত তলাবিশিষ্ট আধুনিক এই মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটি খোলা থাকবে ২৪ ঘণ্টা। ৬০ শয্যার এই কেন্দ্রে আছে ২২টি কক্ষ। পুরুষদের জন্য ১৬টি কক্ষে থাকছে ৪৬টি শয্যা। মহিলাদের ছয়টি কক্ষে শয্যা ১৪টি। ডাবল কেবিনে ২৮টি, ট্রিপল কেবিনে ১৫টি এবং জেনারেল ওয়ার্ডে আছে ১১টি শয্যা। এছাড়া জেনারেল ট্রিপল বেড আছে ছয়টি। জেনারেল ওয়ার্ড ছাড়া সব ওয়ার্ড বা কক্ষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত।
আধুনিক সব প্রযুক্তি
দেশের মাদক নিরাময় কেন্দ্রগুলোতে প্রায়ই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই কেন্দ্রের রুমগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে কেউ আত্মহত্যা করার সুযোগ পাবেন না। সিলিংফ্যানের বদলে বিশেষ ফ্যান স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে ঝুলে আত্মহত্যা করা সম্ভব নয়। ২০ কেজি ওজনের বেশি কিছু ঝুললেই ভেঙে পড়বে ফ্যান। প্রতি রুমে রয়েছে অ্যাটাচ্ড বাথরুম। কেউ যাতে বাথরুমে গিয়ে আত্মহত্যা করতে না পারে সেজন্য তাতে লক সিস্টেম রাখা হয়নি। বাথরুমগুলোর দরজায় লাগানো হয়েছে ম্যাগনেট। শাওয়ারে রডের পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে বিশেষ প্লাস্টিক। তাই শাওয়ারেও আত্মহত্যার সুযোগ নেই।
এছাড়া প্রতি ফ্লোরের সিঁড়িতে আছে বিশেষ লকের ব্যবস্থা। কোনো রোগী ইচ্ছা করলেই এক ফ্লোর থেকে অন্য ফ্লোরে অবাধে চলাচল করতে পারবে না।
যেসব সুবিধা থাকছে
কেন্দ্রটির ভবনের ছাদে রয়েছে বাগান। ছাদবাগানে প্রাকৃতিক পরিবেশে খোলা আকাশের নিচে রোগীরা বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইয়োগা ও মেডিটেশন করবে। ছাদবাগানের পাশে রয়েছে ব্যায়ামাগার। ষষ্ঠ তলায় আছে নার্সিং স্টেশন। পঞ্চম তলায় বিশেষ কেবিন ও ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা। সেখানে আছে টেবিল টেনিসসহ নানা ধরনের খেলার সরঞ্জামাদি। আছে লাইব্রেরি।
চতুর্থ তলায় রয়েছে ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা, সাধারণ ওয়ার্ড এবং সাধারণ কেবিন। ভবনের তৃতীয় তলায় আছে কেবিন ব্লক, ডাইনিং ও বিশেষ নার্সিং স্টেশন।
দ্বিতীয় তলা ব্যবহৃত হবে প্রশাসনিক ব্লক হিসেবে। সেখানে থাকছে প্যাথলজি বিভাগ। আছে সাইকোলজি কাউন্সিলিং ও ফ্যামিলি কাউন্সিলিং এবং স্যাম্পল কালেকশন রুম। ওয়েসিসের স্যাম্পল কালেকশন রুমে কোনো ধরনের বেসিন, বাথরুম বা পানির ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এর ফলে কোনো টেকনিশিয়ান চাইলেও স্যাম্পলের সঙ্গে পানি জাতীয় কিছু মেশাতে পারবে না।
দক্ষ জনবল
ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে জনবল ৮৫ জন। এর মধ্যে একজন পরিচালক (এসপি পদমর্যাদার), তিনজন সহকারী পরিচালক, চারজন কো-অর্ডিনেটর এবং ২৭ জন নার্সিং অফিসার বা মেট্রন। এছাড়া হিসাব শাখায় দুই জন, নিরাপত্তা ও রিসিপশন শাখায় ১১ জন, কন্ট্রোল রুমে ছয়জন এবং প্রশাসন শাখায় জনবল আছে আরও ১৪ জন।
সম্প্রতি আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সুন্দর ও নান্দনিক পরিবেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা সেবা দেবে ৬০ বেডের এই হাসপাতাল। এছাড়া মানিকগঞ্জে পদ্মা নদীর পাশে ১০ বিঘা জমিতে মাদকাসক্তদের জন্য তিনশ থেকে চারশ বেডের বিশ্বমানের অত্যাধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হবে। মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য আর বিদেশে যেতে হবে না।’
প্রকল্প বাস্তবায়নে যারা, তারা কী বলছেন
প্রকল্পটির বাস্তবায়ন তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ওয়েসিসে আন্তর্জাতিক মানের সেবা পাবেন সেবাগ্রহীতারা। আমাদের অনেক সফলতার মাঝে এ প্রকল্পটিও সফলতার মুখ দেখবে বলে আশা করছি।’
তিনি বলেন ‘কয়েক বছরের মধ্যে মানিকগঞ্জে আরও একটি অত্যাধুনিক মাদক নিরাময় কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। সেখানে ইতোমধ্যে ১০ বিঘা জমি কেনা হয়েছে। আরও জমি কেনা হবে। ওই কেন্দ্রটিতে সুইমিং পুল এবং গার্ডেনসহ নানা ধরনের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। প্রস্তাবিত কেন্দ্রটি নির্মাণ করতে কিছুটা সময় লাগবে। এ জন্য আপাতত কেরানীগঞ্জে প্রকল্পটি শুরু করছি। সম্পূর্ণ অলাভজনক এই সেবা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ।’
ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের পরিচালক পুলিশ সুপার ডা. এস এম শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাময় কেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকল্পটি শুরুর আগে আমরা বিভিন্ন মাদক নিরাময় কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। ওই সব কেন্দ্রে যেসব ত্রুটি চোখে পড়েছে, এই কেন্দ্রে সে ধরনের কোনো ত্রুটি রাখা হয়নি। কাজেই নতুন এ প্রকল্পটির সফলতা নিয়ে আমরা আশাবাদী।’
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন
পুলিশের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, ‘মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য পুলিশ যে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে তা সত্যিই ভালো উদ্যোগ। আমরা এই উদ্যোগকে স্যালুট জানাই। ওয়েসিস মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে যে ডোপ টেস্ট মেশিন আনা হয়েছে সেটি অত্যাধুনিক।
বিএসডি/আইপি