ডা. মিনহাজুল আবেদিন
আমাদের মেডিকেলের লেকচারগুলোতে যখন রোল কল করা হতো তখন একটা রোল সবসময়ই অ্যাবসেন্ট থাকতো। আমরা তাকে কখনোই দেখতে পাইনি। আমাদের বন্ধুরা কখনোই তার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। কারণ মেডিকেলের ক্লাস শুরুর আগেই সে সুইসাইড করেছিল।
সুইসাইড করার কারণটা ছিল কিছুটা অদ্ভুত। যতদূর শুনেছি বাবার কাছে ল্যাপটপ চেয়েছিল। বাবা ল্যাপটপ কিনে দেয়নি। অভিমানে আত্মহত্যা। আচ্ছা নিজেকে হত্যা করার জন্য সে কারণটা কি যথেষ্ট ছিল? অবশ্যই না।
কিছুদিন আগে ঢাবির ইমাম হোসাইন নামে একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। কারণ ছিল প্রেমে ব্যর্থতা। যে মেয়েটির কারণে আত্মহত্যা করেছে তার সাময়িক কোনো সমস্যা হবে কিনা জানি না। তবে মেয়েটি আল্টিমেটলি তার পছন্দের মানুষকে নিয়েই বাকি জীবন কাটানোর চেষ্টা করবে।
স্ত্রীর প্রতারণার কারণে আত্মহত্যা করেছিল ডাক্তার আকাশ। এইতো গত বছরের ঘটনা। প্রতারণার অভিযোগে স্ত্রী নিতু কয়েকদিন জেলে থাকলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জামিন পেয়েছিলেন। হাইকোর্টের কৃপায় বহাল তবিয়তেই আছেন এখন। শুধু মাঝখান থেকে নাই হয়ে গেল ডা. আকাশ।
উপরে যাদের কথা বললাম তারা আত্মহত্যা করে কি পেয়েছে আসলে? তাদের আত্নহত্যার জন্য কারণগুলো কি যথেষ্ট ছিল?
আচ্ছা এ রকম অগণিত আকাশ কিংবা ইমামদের সামনে কি আত্মহত্যা ছাড়া কোনো পথই খোলা ছিল না? অবশ্যই ছিল। তবে সে পথটা খোঁজার জন্য যতটুকু ধৈর্য ধরার প্রয়োজন ছিল, ততটুকু ধৈর্যের লিমিট তাদের ছিল না। এই ধৈর্যের লিমিট সবার সমান হয় না। বিপত্তিটা ঠিক এখানেই। যাদের লিমিট বেশি তারাই টিকে থাকে, গেইনার হয় এবং ভাইস ভার্সা।
এই লিমিট জিনিসটা কম থাকার কারণেই মূলত পৃথিবীতে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ সুইসাইড করছে। আর বছরে ৮ লক্ষ। আমাদের দেশে প্রতিবছর ১০ থেকে ২০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছে অর্থাৎ প্রতিদিন ৩০ জনেরও বেশি মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আত্মহত্যা করছে। প্রকৃত সংখ্যাটা নাকি আরো বেশি হবে।
কারা আত্মহত্যা করছে?
এতো মানুষের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান দেখে স্বাভাবিকভাবেই জানতে ইচ্ছে করে কারা আত্মহত্যার মিছিলে নাম লেখাচ্ছে? এরাতো আমাদের চারপাশেরই মানুষ। আর পেশাগত কারণে সম্ভবত চিকিৎসক সমাজে সুইসাইড প্রবণতা একটু বেশিই।
জীবনে কখনো না কখনো সুইসাইড করার চিন্তা করেছে গত কয়েকদিন এমন অনেকের সাথে কথা বলেছি। যাদের অনেকেই suicidal attempt ও নিয়েছিল। তাদের অনেকেরই সুইসাইডাল থট এর পেছনে খুব কষ্টকর কিছু ছিল, আবার অনেকের ক্ষেত্রেই ছিল খুবই সিম্পল কারণ। (এটা নিয়ে একটা সার্ভে করছি, পরে প্রকাশ করবো সেটা)।
ভালো লাগার ব্যাপার হলো যাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের অধিকাংশই খুব ভালো আছে এমনকি আগের চেয়ে অনেক ভালো আছে। শুধু অল্প কয়েকজনকে এমন পেয়েছি যারা সুইসাইডাল থট এর ধকলটা কাটিয়ে উঠলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে তাদের আরো কিছু সময় দরকার।
তবে ভয়ঙ্কর লেগেছে, পরিচিত এমন অনেকের মাথায়ই সুইসাইডের ভাবনা এসেছিল যাদেরকে সবসময় স্বাভাবিক মনে হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের চারপাশেই অনেক মানুষ সুইসাইডের চিন্তা নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে আমাদের অজান্তেই।
আত্মহত্যার নেপথ্যে
সুইসাইডের প্রধান কারণ ডিপ্রেশন, যা অগণিত মানুষকে আত্মহত্যার দুয়ারে ঠেলে দিচ্ছে। ডিপ্রেশন বিভিন্ন কারণে হতে পারে। আমাদের চারপাশে এমন ডিপ্রেসড মানুষ প্রচুর। এই ডিপ্রেশন একদিনেই কাউকে শেষ করে দেয় না। এটা সময় নেয়। একটা কারণের সাথে নতুন আরেকটা কারণ যুক্ত হয়। তখন ডিপ্রেশন বাড়ে। আর সুইসাইডের পথে একটু একটু করে এগোতে থাকে। সর্বশেষ কেউ কেউ হয়তো সুইসাইডকেই নিজের জন্য সমাধান হিসেবে বেছে নেয়, যেটা কখনোই সমাধান নয়।
আমাদের দেশে যে পরিমাণ মানুষ সুইসাইড করছে বা যে পরিমাণ মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগছে এটাকে কমিয়ে আনার জন্য সে পরিমাণ উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। অন্যদিকে এদেশে সাইকিয়াট্রিস্টকে এখনো মানুষ পাগলের ডাক্তার হিসেবেই চেনে। এ ট্যাবু ভাঙা দরকার। একবারতো একজনকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়ার কথা বলে ঝাড়িও খেয়েছিলাম।
একটা অনুরোধ সবার প্রতি, আমরা আমাদের চারপাশের হতাশায় ভোগা মানুষগুলোর প্রতি আন্তরিক হোন প্লিজ। আমরা তাদের সমস্যাগুলো সমাধান করতে না পারি, শুনতে তো পারি। ডিপ্রেশনের কথা অন্যকে বলতে পারলে ডিপ্রেশন কমে।
প্রতি বছর বিশ্বে ১০৮ মিলিয়ন মানুষ সুইসাইডজনিত কারণে স্বজনহারা হয়। আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টা এই সংখ্যাটাকে হয়তো কিছুটা হলেও কমিয়ে আনতে পারে।
সর্বশেষ সবার কাছে একটা প্রশ্ন, সফলতা এবং বেশি থেকে বেশি প্রাপ্তির প্রচণ্ড প্রতিযোগিতায় পড়ে আমরা কেউ কেউ (হয়তোবা নিজের অজান্তেই) আমাদের কথাবার্তা, কাজ কর্ম অথবা আচরণের মাধ্যমে অন্য কারো ডিপ্রেশন বাড়িয়ে দিচ্ছি না তো? কিংবা দিনে দিনে নিজেই ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছি নাতো?
ডা. মিনহাজুল আবেদিন
প্রাক্তন শিক্ষার্থী,
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ