নিজস্ব প্রতিবেদক:
কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনের সংসদ সদস্য ও দেশের খ্যাতিমান চিকিৎসক অধ্যাপক ডাক্তার প্রাণ গোপাল দত্ত। ১৯৫৩ সালের ১ অক্টোবর চান্দিনার মহিচাইল গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সাবেক ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফের মৃত্যুতে শূন্য আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন তিনি।
২০ সেপ্টেম্বর তাকে একক প্রার্থী ঘোষণা করে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার। পরে ২৬ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন সচিব হুমায়ূন কবীর খোন্দকার স্বাক্ষরিত গেজেটের মাধ্যমে ডা. প্রাণ গোপাল দত্তকে সরকারিভাবে সংসদ সদস্য ঘোষণা করা হয়।
কুমিল্লার এই সন্তান এমপি হওয়ায় এলাকায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। জেলার অধিকাংশ মানুষ ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের প্রতি আস্থা রাখছেন। তারা মনে করেন, স্বাস্থ্যখাত ও মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করতে পারবেন তিনি।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, বাড়িতে তার পড়ালেখার হাতিখড়ি। মহিচাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুলজীবন শুরু তার। ১৯৬৮ সালে চান্দিনা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৫ বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্ক নিয়ে মেট্রিক পাস করেন তিনি। এই পরীক্ষায় চান্দিনা থানাতে তিনি সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিলেন। পরে ১৯৭০ সালে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে তিন বিষয়ে লেটারসহ ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি।
ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের বাবা কালা চান দত্ত এবং মায়ের নাম কিরণ প্রভা দত্ত। ৪ ভাই ৩ বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৭৯ সালের ১৮ জুন তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রী জয়শ্রী রায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে গাইনি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। এক কন্যা ডা. অনিন্দিতা দত্ত, এক পুত্র অরিন্দম দত্ত বিদেশে অধ্যায়নরত।
প্রাণ গোপাল দত্তের বড় ভাই ননী গোপাল দত্ত বলেন, প্রথমে তিনি ডাক্তারি বিষয় পড়াশোনা করতে চায়নি। ঢাকা বিশ্ব্যবিদ্যালয়ের কেমেস্ট্রিতে ভর্তি হয়েছিলেন। তবে বাবার ইচ্ছে ছিল সে ডাক্তার হবে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল ভর্তি হয়। তখন টিউশনি করে অনেক কষ্টে পড়াশুনা খরচ চালিয়েছে। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে ৭ম স্থান নিয়ে এমবিবিএস শেষ করেন। প্রাণ গোপাল দত্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে এমএস এবং পিএইচডি করেছেন।
অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত চট্টগ্রাম মেডিকেলের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরে সক্রিয়ভাবে কাজ করেন তিনি। মুজিববাহিনীর পক্ষে খ্যাতিমান এই চিকিৎসক অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারকে চিঠিপত্র লিখতেন।
১৯৭৭ সালে হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নাক কান গলা বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে ডা. প্রাণ গোপাল দত্তের কর্মজীবন শুরু হয়।সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োজিত ছিলেন চট্টগ্রাম ও রংপুর মেডিকেল কলেজে। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে তৎকালীন আইপিজিএমআর বা পিজি হাসপাতাল ও ন্যাশনাল সেন্টার হেয়ারিং ও স্পিস সেন্টারে কাজ করেছেন।
অধ্যাপক হিসেবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৯৯ সালে যোগদান করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে নাক কান গলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান পদে। ২০০০ সালে ট্রেজারার পদে দায়িত্ব পান তিনি। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই পদে দায়িত্ব পালন করেন। একই বছরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে দায়িত্ব পান। পর পর দুই মেয়াদি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন অধ্যাপক প্রাণ গোপাল দত্ত। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডান কানে প্রচণ্ডভাবে আঘাতপ্রাপ্ত, শ্রবণ ক্ষমতা কমে যায়। তখন ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালানা করেন।
২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে সেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করলেও এখনও হাজার হাজার রোগীর আশা ভরসার স্থল হিসেবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিতেই। সাদামাটা জীবনের অধিকারী এই মহান ব্যক্তি বহু বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ রচনা করেছেন। যা দেশে বিদেশে নামিদামি বিভিন্ন মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া স্বাস্থ্য সচেতনায় দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন সংবাদ মাধ্যমে নিয়মিত লিখে থাকেন তিনি। স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সরকারি বেসকারি বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ কমিটিতে কাজ করছেন তিনি। এছাড়া তিনি সাইমা ওয়াজেদের নেতৃত্বে অটিজম ও স্নায়ুবিকলজনিত সমস্যা নিয়ে কাজ করছেন।
প্রাণ গোপাল দত্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসামন্য অবদার রাখায় স্বীকৃতি হিসেবে ২০১২ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন। একই বছর বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ অর্জন করেন তিনি। ২০১১ সালে ইউজিসি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন।
কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, আমরা একসঙ্গে ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়াশুনা করেছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, জননেত্রী শেখ হাসিনার ৪১’এর একটি জ্ঞাননির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমরা যেভাবে কাজ করছি, আমার বিশ্বাস ডা. প্রাণ গোপল দত্ত ঠিক সেভাবে কাজ করবে।
মহিচাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিমাই চন্দ্র দাস বলেন, শুনেছি ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত এই স্কুলে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। তখন এই স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায় বাবার ইচ্ছাপূরণে চান্দিনা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। কর্মজীবনে এত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি স্কুলে বিভিন্ন সময় এসে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দিতেন, ক্লাস করাতেন। তিনি বর্তমানে মহিচাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় আমরা খুবই আনন্দিত।
উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চট্টগ্রাম থেকে যখন ঢাকায় কর্মজীবন শুরু করেন তখন থেকেই তিনি চান্দিনার মানুষের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা শুরু করেন। সুখেদুঃখে সব সময় পাশে ছিলেন। কয়েক দশক ধরে ওনার সাথে আমার পরিচয়। তখন থেকে কয়েকজন চিকিৎসকের সমন্বয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার তার মতো ব্যক্তির খুব প্রয়োজন। তিনি চান্দিনাকে মডেল উপজেলা বানাতে চান।
ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আবু জাফর খাঁন বলেন, ১৯৭০ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। জনপ্রিয় এই চিকিৎসক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় ভিক্টোরিয়া কলেজ পরিবার খুবই আনন্দিত।
ভিক্টোরিয়া কলেজে থাকাকালীন তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ৬৮ বছর বয়সী নাক, কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ প্রাণ গোপাল তিন মেয়াদে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগে সহ-সভাপতি পদে রয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও চান্দিনার এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন প্রাণ গোপাল।
তবে সেবার আওয়ামী লীগ দলের নেতা সদ্য প্রয়াত আলী আশরাফকেই বেছে নেয় প্রার্থী হিসেবে। সাবেক ডেপুটি স্পিকার আশরাফ ওই আসন থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সাবেক ডেপুটি স্পিকার আলী আশরাফের মৃত্যুতে শূন্য কুমিল্লা-৭ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হন ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। চিকিৎসাসেবা, গবেষণা, মেডিকেল উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনায় অবদান রাখা মানুষটি এখন জনপ্রতিনিধি হিসেবে যাত্রা শুরু করেছেন।
উপনির্বাচনে বিজয়ী সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত আজ শপথ গ্রহণ করবেন বলে জানা গেছে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তাকে শপথবাক্য পাঠ করাবেন।
বিএসডি/আইপি