আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জাঞ্জিবার দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী লেখক আবদুলরাজাক গুরনাহর সাহিত্যে নোবেলপ্রাপ্তি ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে তানজানিয়ায়। অনেকেই শরণার্থী জীবনের গল্প লিখে গুরনাহর সাহিত্যে নোবেল জয়কে উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে উদযাপন করলেও তানজানিয়ায় তার পরিচয় নিয়ে প্রাণবন্ত বিতর্কেরও শুরু হয়েছে।
আফ্রিকার মুষ্টিমেয় কয়েকজন ঔপন্যাসিক মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার পেয়েছেন। গুরনাহ সর্বশেষ ওই অঞ্চলের ঔপন্যাসিক হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। তানজানিয়ার অনেকেই তার কাজ এবং পুরস্কারপ্রাপ্তির প্রশংসা করেছেন। তবে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, তানজানিয়ানরা কি সত্যিই যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক গুরনাহকে নিজেদের লেখক বলে দাবি করতে পারেন?
গুরনাহর কাজকর্মের মধ্যে ১০টি উপন্যাস আছে। ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে তানজানিয়ার দ্বীপপুঞ্জ জাঞ্জিবার থেকে শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান তিনি। আফ্রিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ওপর সংখ্যালঘু আরবদের রাজনৈতিক আধিপত্যের অবসান ঘটানো বিপ্লবের তিন বছর পর তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে গভীর বিভাজন, উত্তেজনা এবং প্রতিহিংসা তানজানিয়ায় বিপ্লব ডেকে আনে।
নিজের গল্প স্মরণ করে গুরনাহ বলেন, ব্রিটেনে যাওয়ার জন্য মাত্র এক মাসের পর্যটক ভিসা পেয়েছিলেন তিনি; যা তাকে ব্রিটেন ভ্রমণের সুযোগ করে দেয়। সেখানে পৌঁছানোর পর দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের ক্যান্টারবুরির একটি টেকনিক্যাল কলেজে এ-লেভেলে পড়ার জন্য ভর্তি হন তিনি।
বৃহস্পতিবার সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারের ঘোষণায় সুইডিশ একাডেমি বলেছে, ভাগ্যাহত শরণার্থীদের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা আর তাদের জীবনে ঔপনিবেশিকতার প্রভাব নিজের লেখনীতে দ্ব্যর্থহীনভাবে ফুটিয়ে তুলে সাহিত্যে চলতি বছর নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ৭৩ বছর বয়সী আব্দুলরাজাক গুরনাহ।
পুরস্কার ঘোষণার পরপরই তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং আধা-স্বায়ত্তশাসিত জাঞ্জিবার দ্বীপ গুরনাহর এই অর্জনের প্রশংসা করেন। তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট সামিয়া সুলুহু হাসান এক টুইট বার্তায় বলেন, এই পুরস্কার আপনার, তানজানিয়ান জাতির এবং আফ্রিকার সাধারণ জনগণের জন্য সম্মানের। জাঞ্জিবারের নেতা হুসেইন আলী মুইনি বলেছেন, ‘ঔপনিবেশিকতা সম্পর্কিত বয়ানকে ঘিরে আপনার লেখনী আমরা সানন্দে চিনতে পারি। এ ধরনের আখ্যান শুধু আমাদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য সম্মান বয়ে আনে।’
গুরনা নিজেও টুইটারে লিখেছেন, ‘এই নোবেল পুরস্কার আফ্রিকা, আফ্রিকান এবং আমার সকল পাঠকদের জন্য উৎসর্গ’ করছি।
ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইউনিভার্সিটি অব কেন্ট থেকে অবসরে যাওয়া এই অধ্যাপক তানজানিয়ার সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্কের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার পরিবার এখনও বেঁচে আছে, আমার পরিবার এখনও সেখানে বাস করে। সময়ে পেলে আমি সেখানে যাই। তানজানিয়ার সঙ্গে এখনও আমার সম্পর্ক আছে। আমি সেখানকার। মননে আমি এখনও সেখানেই বাস করি।
গুরনাহর নোবেল জয় দেশটিতে তার পরিচয় সম্পর্কে দীর্ঘ এবং আবেগময় অনলাইন আলোচনার জন্ম; এমনকি অপ্রত্যাশিতভাবে জাঞ্জিবার এবং মূল ভূখণ্ডের সম্পর্ক নিয়েও রাজনৈতিক বিতর্ক উসকে দিয়েছে। জাঞ্জিবার আধা-স্বায়ত্তশাসিত হওয়ার পরও মূল ভূখণ্ডের সাথে সম্পর্ক বৈরীতাপূর্ণ। জাঞ্জিবারের আলাদা পার্লামেন্ট, প্রেসিডেন্ট আছে; মূল ভূখণ্ডের কাছে আরও বেশি স্বাধীনতা চায় এই দ্বীপ।
সমাজ বিজ্ঞানী আইকান্দে কোয়ু এক টুইটে বলেছেন, আবদুলরাজাক গুরনাহর ‘তানজানিয়ান’ পরিচয় সম্পর্কে বিতর্ক শুরু হওয়া উচিত। আমাদের সরকারকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে ভাবতে হবে: এক. ন্যায়বিচার; দুই. দ্বৈত নাগরিকত্ব; তিন. ইউনিয়ন সম্পর্কিত বিষয়; চার. মানসম্মত শিক্ষা এবং শিখন— লেখালেখি ও সাহিত্যের চর্চা আমরা কীভাবে করব?
দ্বৈত-নাগরিকত্বের বিষয়টি দেশটির দীর্ঘদিনের পুরোনো এক বিতর্ক। তানজানীয়রা— বিশেষ করে প্রবাসীরা এটি বাস্তবায়নের পক্ষে নিজেদের মতামত দেন। তবে দেশটির প্রায় সব সরকারই সাংবিধানিক বিধি-নিষেধের কথা বলে এর বাস্তবায়ন থেকে বিরত থেকেছে।
দেশটির সাংবাদিক এরিক কাবেনডেরা লিখেছেন, তানজানিয়া দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমোদন দিতে পারে না; তার অন্যতম কারণ হলো—আবদুলরাজাক গুরনাহ এবং তার দাদা-দাদি; যারা জাঞ্জিবার বিপ্লবের সময় আরবদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে পালিয়েছিলেন, তারা ফিরে আসবেন এবং তাদের চুরি যাওয়া সম্পত্তি দাবি করবেন। এবং আমরা নির্লজ্জভাবে তার বিজয় উদযাপন করছি?
তবে অন্যান্যরা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে বিদেশে কাটিয়ে দেওয়ায় তাকে শিকড় থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের সোয়াহিলি স্টাডিজের অধ্যাপক ইদা হাদজিভায়ানিস বলেন, গুরনাহ নিজেকে জাঞ্জিবার বংশোদ্ভূত তানজানিয়ান বলে পরিচয় দেন। প্রবাসে বসবাস, নির্বাসিত হওয়া, এমনকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্নের বোধ তার ঐতিহ্য এবং পরিচয় কেড়ে নেয় না। তিনি কে, এসব তারই অংশ।
তিনি বলেন, ‘এমন অনেক মানুষ আছেন যারা সন্তানদের নিয়ে প্রবাসে বসবাস করেন, যাদের জাতীয়তা বিদেশি কিন্তু তানজানিয়ান বলে পরিচয় দেন— এবং সেটিই তাদের মাতৃভূমি।’
জাঞ্জিবার বংশোদ্ভূত হাদজিভায়ানিস বলেছেন, গুরনাহর নোবেল জয়ে তিনি এতটাই আনন্দিত হয়েছেন যে, ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি বলেন, গুরনাহ এমন একজন লেখক, যিনি সত্য কথা বলেন। তার কাজকে সৎ হিসাবে বর্ণনা করেন হাদজিভায়ানিস। বলেন, তাদের (বইয়ের চরিত্রগুলোর) অভিজ্ঞতা পরিচিত, তাদের বাড়ির (তানজানিয়া এবং বিশেষ করে জাঞ্জিবার) সাথে সম্পর্ক প্রায়ই একই সুরে আঘাত করে।
হাদজিভায়ানিস ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো গুরনাহর বই পড়েছিলেন। বর্তমানে ১৯৯৪ সালে গুরনাহর লেখা উপন্যাস প্যারাডাইন সোয়াহিলি ভাষায় অনুবাদ করছেন তিনি। তানজানিয়ায় এখনও অনেকেই এই লেখকের বই পড়েননি উল্লেখ করে দেশটির সরকারের কাছে গুরনাহর লেখা স্কুল পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান হাদজিভায়ানিস।