সময়ের হিসাবে রবিবার পেরিয়ে তখন সোমবার প্রথম প্রহর। রাত ১২টা ৫ মিনিট। রাজধানীর ভাটারার খাঁপাড়ায় বাদশার গ্যারেজে চলছিল সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে উচ্চস্বরে গান-বাজনা। সেখানে জমায়েত প্রায় অর্ধশত যুবক এর আয়োজক। তারা গান-বাজনার সঙ্গে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছিল। উপরন্তু কারোর মুখেই ছিল না মাস্ক। স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে ডিজে গানের সঙ্গে চলছিল তাদের নাচানাচি। বিকট আওয়াজ আর বিশৃঙ্খলায় অতিষ্ঠ হয়ে একপর্যায়ে এলাকাবাসী শরণাপন্ন হন জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর। সেখান থেকে খবর পেয়ে গান থামাতে দায়িত্বরত পুলিশের দল নিয়ে বাদশার গ্যারেজে যান ভাটারা থানার এসআই মোহাম্মদ আলী। ভেবেছেন, পুলিশ দেখে যুবকরা ‘দুঃখিত’ বলে গান-বাজনা বন্ধ করে দেবে।
কিন্তু ঘটনা ঘটে উল্টো ও অপ্রত্যাশিত। পুলিশ দেখে মারমুখী হয়ে ওঠে বখাটেরা। জীবন হোসেন নামে ক্ষিপ্ত এক যুবক পুলিশদের উদ্দেশে ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলেন- ‘আমরা নেতা নান্নু ভাইয়ের লোক। গান-বাজনা বন্ধ করা যাবে না।’ পুলিশের কথায় কর্ণপাত না করে ফের নাচ-গানে মেতে ওঠে তারা। এ সময় এসআই মোহাম্মদ আলী এগিয়ে গিয়ে সাউন্ড সিস্টেমের লাইন নিষ্ক্রিয় করতে গেলে ৩০ থেকে ৩৫ যুবক এসে পুলিশের ওপর হামলে পড়ে; গালাগাল দিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়ে তারা। একপর্যায়ে এসআই মো. আলীকে টেনেহিঁচড়ে তার পরনের ইউনিফরম ছিঁড়ে ফেলে বখাটেরা।
এখানেই হেনস্তার শেষ নয়। ওই এসআইকে বাঁচাতে সহকর্মী কনস্টেবল মফিজুল হাকিম ও আনারুল ইসলাম এবং আনসার সদস্য নাজমুল ইসলাম এগিয়ে এলে সঙ্গে এক যুবক বলে ওঠেন- ‘দরজা বন্ধ কর, আইজ পুলিশ পিটামু’। তার আদেশ পেতেই মারমুখী হয়ে ওঠে সবাই। একপর্যায়ে দরজা আটকে ৪ পুলিশ সদস্যকে লাঠিপেটা করা ছাড়াও এলোপাতাড়ি মারধর করে তারা। খবর পেয়ে থানা থেকে আরও পুলিশ সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে আহত সহকর্মীদের গ্যারেজ থেকে উদ্ধার করে। গভীররাতে আহত পুলিশ সদস্যদের ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে।
ভাটারা থানার ওসি মো. মোক্তারুজ্জামান জানান, পুলিশ সদস্যদের মারধরের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এতে জড়িত ৬ জনকে গ্যারেজ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
গত রবিবার মধ্যরাতে দরজা আটকে পুলিশের ওপর এ হামলার ঘটনায় পরদিন ভুক্তভোগী এসআই মোহাম্মদ আলী বাদী হয়ে হত্যাচেষ্টাসহ কয়েকটি ধারায় গ্রেপ্তার মো. জীবন হোসেন, আরিফুর রহমান, রহিম, সাইদুল ইসলাম, আরাফাত রহমান মনি ও মো. আবদুর রহিমসহ মোট ২২ জনের বিরুদ্ধে ভাটারা থানায় মামলা দায়ের করেন। গ্রেপ্তার ৬ জনকে একদিন করে রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার এসআই মো. নাজমুল হুদার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুন অর রশিদের আদালত তাদের এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলায় এজাহারভুক্ত পলাতক অন্য আসামিরা হলেন- মো. নেহাল, ইমরান হোসেন হিরা, শামছুল হক রানা, মাসুম কাজী, রাশেদ কাজী, লিটন কাজী, রিপন, রাব্বি, শামীম, সিয়াম, রুবেল, রবিন, রাকিব, সোহাগ, আকাশ ও মো. মানিক। মামলায় অচেনা আরও ১৫ জনকেও আসামি করা হয়। সব আসামি ভাটারা থানা এলাকার বাসিন্দা; বয়স ১৮ থেকে ২৪-এর মধ্যে।
আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা (জিআরও) মাজহারুল ইসলাম জানান, সোমবার ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ৬ আসামিকে হাজির করে তাদের প্রত্যেকের সাত দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক তাদের একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
হামলার শিকার এসআই মো. আলী জানান, আসামিদের প্রত্যেকেই স্থানীয় বখাটে হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় এক শ্রমিক নেতার সঙ্গে তাদের চলাফেরা আছে। হয়তো তার ক্ষমতার দাপটেই এসব বখাটে দায়িত্ব পালনরত পুলিশের দলকে পেটাতেও দ্বিধা করেনি। তিনি বলেন, বখাটে যুবকরা যেভাবে আমাদের ওপর হামলা চালায় তা কল্পনাতীত। থানা থেকে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যরা এগিয়ে না এলে আমাদের ৪ জনেরই প্রাণনাশের শঙ্কা ছিল।