নিজস্ব প্রতিবেদক:
উজানের ঢলে তিস্তা নদী অববাহিকা লন্ডভন্ড হয়েছে। ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেওয়ায় আকস্মিক বন্যায় রংপুর, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলার নদীবেষ্টিত বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবার। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, আবাদি জমিসহ ধান, আলু, শাকসবজি ও অন্যান্য ফসলের ক্ষেত। পানির তীব্র স্রোতে নদীভাঙনের ফলে সড়কপথেও ভাঙন শুরু হয়েছে।
এরই মধ্যে রংপুর-লালমনিরহাট জেলার আঞ্চলিক সড়কের একটি অংশ ধসে গেছে। বন্ধ হয়ে গেছে রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর শেখ হাসিনা সেতু থেকে লালমিনরহাটের কালীগঞ্জ কাকিনা পর্যন্ত সড়কপথে যোগাযোগ। ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন ওই পথ দিয়ে চলাচলকারী বিভিন্ন এলাকার মানুষজন। এছাড়া বিভিন্ন চর এলাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বাঁধগুলোও ঝুঁকিতে রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নীলফামারীর ডালিয়ার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পরিমাপক নুরুল ইসলাম জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) বিকেল ৩টায় বিপৎসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। এর আগে বুধবার (২০ অক্টোবর) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিপৎসীমার ৬৫-৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় তিস্তা নদীর পানি।
বুধবার (২০ অক্টোবর) ভোর থেকে উজানের এমন ঢলে প্রথমে বিধ্বস্ত হয় জিরো পয়েন্টে ভারত বাংলাদেশের নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের পানি উন্নয়ন বোর্ডের গ্রোয়েন বাঁধ। বাধটি বিধ্বস্থ হলে ৩ শতাধিক বসতঘর, আসবাবপত্র, ফ্রিজ, টেলিভিশন ও মোটরসাইকেলসহ ঘরের আসবাবপত্র ভেসে যেতে থাকে। এরপর বেলা ১১টায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাড ফিউজ (ফ্লাড বাইপাস) পানির তোড়ে ভেঙে গেলে চরম হুমকিতে পড়ে তিস্তা ব্যারাজ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ৬৯৬ মিটার দীর্ঘ ফ্লাড ফিউজের আড়াইশ মিটার ভেঙে নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার সড়কপথ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।স্মরণকালের এমন বন্যা ও ভাঙন পথে বসিয়ে দিয়েছে নদী তীরবর্তী মানুষদের। এ জেলায় অন্তত ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
ডিমলা উপজেলা ফায়ার সার্ভিসের ইনচার্জ এটি এম গোলাম মোস্তফা জানান, তিস্তার বন্যায় চর এলাকায় আটকা পড়া অসংখ্য পরিবারকে উদ্ধার করে নিরাপদে সরিয়ে আনা হয়েছে। এ কারণে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ডালিয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী আসফুদ্দৌলা বলেন, তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি লাল সংকেত অব্যাহত রয়েছে।
নীলফামারী জেলা প্রশাসক হাফিজুর রহমান জানান, প্রাথমিকভাবে ডিমলা উপজেলায় ৪০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বন্যা ও ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোকে ডান তীর বাঁধসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে ও শুকনা খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
লালমনিরহাট এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফ আলী খান বলেন, লালমিনরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার কাকিনা ইউনিয়নের রুদ্ধেশ্বর এলাকায় যে অংশে সড়ক ধসে গেছে সেখানে সাধারণ বালুর বস্তা দিয়ে মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা যথাপুযক্ত না হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। আশা করছি শুক্রবার (২২ অক্টোবর) সকাল থেকে সেখানে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকানোর কাজ শুরু হবে। তিনি আরও বলেন, সড়কের একপাশ ধসে যাওয়ায় ঝুঁকি এড়াতে যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রংপরের গঙ্গাচড়া উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নের অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছিলেন। তবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে পানি কমতে থাকায় এখন ভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন মানুষজন।
কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের চর ঢুষমারা, গদাই, পাঞ্জরভাঙ্গাসহ তিস্তা নদী-তীরবর্তী বেশ কিছু গ্রামে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে সেখানকার অন্তত দুই হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। একই চিত্র পীরগাছা উপজেলাতেও।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) রংপুর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, দেশের উজানে ভারতের সিকিম, দার্জিলিং, জলপাইগুড়িতে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে। সেখান থেকে ভাটির দিকে ধেয়ে আসা পানিতে ফুলেফেঁপে উঠেছে তিস্তা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে তিস্তা ব্যারাজের সবকটি (৪৪টি) জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।
রংপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা এ টি এম আখতারুজ্জামান বলেন, বুধবার বন্যাকবলিতদের ২৫ টন চাল ও ৭০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণ রয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী ত্রাণ বিতরণ করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী (উত্তরাঞ্চল) জ্যোতি প্রসাদ বলেন, স্মরণকালের এ বন্যায় তিস্তা ব্যারাজ ও নদী রক্ষার প্রায় নয়টি স্পার্ক, ক্রস ও গ্রোয়েন বাঁধ বিধ্বস্ত হয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ১৭০ মেট্রিক টন চাল ও আট লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বিএসডি / আইকে